স্টাফ রিপোর্টার: বিভাগীয় শহর বরিশাল যেন অবরুদ্ধ। ধর্মঘটে অচল সড়ক ও নৌপথ। দূরপাল্লার লঞ্চ-বাস চলাচল বন্ধ। চলছে না তিন চাকার যানও। ফলে কার্যত সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বরিশাল। বিএনপির অভিযোগ, বিভাগীয় গণসমাবেশ ঠেকাতে ক্ষমতাসীন দলের ইশারায় পরিবহণ ধর্মঘট ডেকে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। যদিও তা স্বীকার করেননি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। মাইক্রোবাস বন্ধ থাকবে। বন্ধের কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। সমাবেশস্থলে দুদিন আগে থেকে জড়ো হওয়া নেতা-কর্মীর অধিকাংশই মাঠে রাত কাটাচ্ছেন। সামিয়ানা আর ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে মাঠেই রাত পার করছেন তারা।
এদিকে গণসমাবেশ সফলে বিএনপির মিছিল-সমাবেশের পাশাপাশি নগরীতে মোটরসাইকেল শোডাউন-মিছিল-সমাবেশ করছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগ। বৃহস্পতিবারও মিছিল করেছেন ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এসব মিছিলে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে দেয়া হচ্ছে সন্ত্রাস নৈরাজ্যের সেøাগান। পালটা হিসাবে বিএনপির মিছিল সমাবেশেও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তোলা হচ্ছে গণতন্ত্র ধ্বংসের অভিযোগ। সবমিলিয়ে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে বরিশালে। সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কায় সাধারণ মানুষ। পুলিশ বলছে, কোনো অবস্থাতেই নগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হতে দেয়া হবে না। শনিবার দুপুর দেড়টায় বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ। এই সমাবেশ ঘিরে বহু বছর পর উত্তপ্ত বরিশাল নগরী। বিএনপি যেমন মরিয়া সমাবেশ সফলে তেমনি ক্ষমতাসীন দলও নেমেছে মাঠ দখলে রাখার মিশনে। দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশের তুলনায় এখানে বাধাও যেন বেশি। ইতোমধ্যে এসেছে বাস ও থ্রি-হুইলার ধর্মঘটের ঘোষণা। যা কার্যকর হয়েছে আজ সকাল থেকে। মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধের দাবিতে বাস মালিকরা এবং তা চলতে দেওয়ার দাবিতে থ্রি-হুইলার মালিকরা ডেকেছেন এই ধর্মঘট। দুই সংগঠনের এ ধর্মঘট চলবে শনিবার বিএনপির গণসমাবেশ শেষ হওয়ার দিন বিকেল পর্যন্ত। কোনোরকম ঘোষণা দেয়া না হলেও বুধবার রাত থেকে বন্ধ হয়ে গেছে দ্বীপ জেলা ভোলার সঙ্গে বরিশালের যাত্রীবাহী লঞ্চ এবং স্পিডবোট চলাচল। ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন শ্রমিক লীগের নেতাদের নির্দেশনা অনুযায়ী লঞ্চ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মালিক সমিতির নেতারা। মোটরবাইক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার চলাচলেও বাধা সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। মহাসড়কে বাইকে একসঙ্গে তিনজন দেখলেই থামিয়ে করা হচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদ। একই ঘটনা ঘটছে প্রাইভেট কার এবং মাইক্রোবাসের ক্ষেত্রেও। এক কথায় বৃহস্পতিবার থেকে যেন বরিশালে ঢুকতেই নিতে হচ্ছে অনুমতি। এক কথায় অবরুদ্ধ বরিশাল। দেশের অন্যকোনো স্থানের সঙ্গে বরিশালের যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ। তারপরও বিভিন্ন পথে মানুষ বরিশালে ঢুকছে। কেউ হেঁটে, কেউবা বাইসাইকেলে। কেউবা ঘুরাপথে নানা ঝক্কি-ঝামেলা সহ্য করে আসছেন বরিশালের দিকে। গণসমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, কয়েক হাজার নেতাকর্মী দুই রাত মাঠে কাটানোর প্রস্তুতি নিয়ে তাব টাঙিয়েছেন। কেউ কেউ মাঠেই বিশেষ ব্যবস্থায় রান্নার ব্যবস্থা করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে বরিশাল বঙ্গবন্ধু উদ্যানে গিয়ে দেখা গেছে, নেতা-কর্মীরা কেউ গান গেয়ে, মিছিলের সেøাগান দিয়ে জমায়েত জমজমাট করে রেখেছেন। ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার চর মাইনকা ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মহসিন সিকদার বলেন, অসম্ভব দুর্ভোগ-দুর্দশা সহ্য করে সমাবেশস্থলে এসেছি। সরকার সব বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা ট্রলার ভাড়া করে কয়েক হাজার মানুষ এসেছি। এতো কষ্ট করছি শুধু ভোটাধিকার ফেরত পাওয়ার জন্য। ১৫ বছর ধরে ভোট দিতে পারি না। অথচ দেশ স্বাধীন হয়েছিল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েই। যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ পড়েছেন ভোগান্তিতে।
চিকিৎসাসহ নানা কাজে বিভাগীয় শহরে আসতে মানুষকে দুর্ভোগ পোয়াতে দেখা যাচ্ছে। এদিকে সমাবেশস্থল বঙ্গবন্ধু পার্ক ময়দানের বড় একটি অংশ প্রশাসন বাঁশের কাঠামো দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। অনুষ্ঠানের এতো আগেই একটি অংশ ঘিরে ফেলা নিয়ে শহরে নানা আলোচনা চলছে। এই অংশ নিয়ে সমাবেশের দিন নাটকীয় কিছু ঘটে কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। যদিও বিএনপি নেতৃবৃন্দের দাবি, পুরো ময়দান দেয়া হয়েছে। সেখানে ‘আংশিক বা অর্ধেক ব্যবহার যোগ্য’ এমন কোনো শব্দ নেই। পরিবহন ধর্মঘট ৪ নভেম্বর শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ৩ নভেম্বর থেকেই বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
এতো বাধার পরও বরিশালে ৫ই নভেম্বরের বিভাগীয় সমাবেশে যোগ দিতে মানুষ আসছে। এরই মধ্যে সমাবশেস্থলে বিপুল মানুষের আধিক্য লক্ষ করা গেছে। তাদের অনেকের হাতেই ব্যাগ। অর্থাৎ এরা দূর-দূরান্ত থেকে সমাবেশে যোগ দিতে ২/৩ দিন আগেই বরিশাল পৌঁছেছেন। দলে দলে ভাগ হয়ে গল্পগুজব করে সময় কাটাচ্ছেন। কেউ বা ছুটছেন হোটেলে একটি সিটের জন্য। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বরিশালের কোনো হোটেলে সিট খালি নেই। প্রশাসনের কড়াকড়ির পরও আগত বিএনপি নেতা-কর্মীদের একটি অংশ হোটেলে উঠে পড়েছেন। কেউ অগ্রিম সিট বুকিং দিয়ে রেখেছেন। মেলোডি হোটেলের মালিক শাহীন জানান, ৩/৪দিন আগেই ভোলা, চরফ্যাশন, বরগুনা, পটুয়াখালী থেকে সিট বুকিং দেয়া হয়েছে। হোটেল কাউন্টারে সিটের জন্য ভিড়। মতলব আলী এসেছেন গলাচিপা থেকে। ২দিন আগেই এসেছেন। তিনি জানান, একসাথে দল বেধে আসা সম্ভব নয়, তাই ৪/৫জন করে পৃথকভাবে এসেছেন। বরিশালে একত্রিত হয়ে এখন হোটেল খুঁজছেন। হোটেল না পেলে রাতে লঞ্চ ঘাট বা হাসপাতাল চত্বরে থাকবেন। এদিকে সমাবেশস্থল বঙ্গবন্ধু পার্ক ময়দানে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।
ভোলা জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির সোপান বলেন, ‘আমরা ভোলা থেকে ১০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী গণসমাবেশে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছি। আমাদের ঠেকাতে ৩ দিন আগে থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে লঞ্চ ও স্পিডবোট। কিন্তু এতে আসলে কোনো লাভ হবে না। আমরা নদী সাঁতরে হলেও বরিশালে যাব।’ গৌরনদী উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবুল হোসেন মিয়া বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীদের সিংহভাগ ইতোমধ্যে বরিশালে পৌঁছে গেছেন। যাওয়ার পথে নানাভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে তাদের। পথে পথে চেকপোস্ট বসিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা। অনেকে বহু পথ ঘুরে বরিশালে গেছেন।’
পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব স্নেহাংশু সরকার কুট্টি বলেন, ‘সড়কপথে বাধার কারণে নৌপথে ট্রলারে আসছেন আমাদের নেতাকর্মীরা। ৮-১০টি করে ট্রলার বরিশালে এসে লোক নামিয়ে দিয়ে আবার পটুয়াখালী যাচ্ছে লোক আনতে।’
হিজলা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল গাফফার তালুকদার বলেন, ‘রাতের অন্ধকারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে যাতে কেউ গণসমাবেশে না যায়। যারা গণসমাবেশে যাবে তাদের তালিকা করে পরে ‘সাইজ করা হবে’ বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তবে এসবে ভয় না পেয়ে আমাদের নেতাকর্মীরা যে যেভাবে পারছেন বরিশালে যাচ্ছেন।’
ঝালকাঠীর নলছিটি উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনিসুর রহমান হেলাল খান বলেন, ‘শুধু লঞ্চ-বাস নয়, ভ্যান-রিকশায় পর্যন্ত যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি আগে কোনোদিন দেখিনি।’
বিভাগীয় গণসমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির উপদেষ্টা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘বরিশালে নজিরবিহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে ক্ষমতাসীন দল। চট্টগ্রাম, রংপুর, খুলনা, ময়মনসিংহে যা দেখেছি তার সবটা মেলালেও বরিশালের সমান হবে না। এরা (আওয়ামী লীগ) যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে বরিশালের গণসমাবেশ ঠেকাতে। অঘোষিত কারফিউ চলছে এখানে। লঞ্চ-বাস, থ্রি-হুইলার এমনকি খেয়া পারাপার পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার ওপর চলছে সরকারি দলের মোটরসাইকেল মহড়া, উসকানিমূলক মিছিল সমাবেশ এবং পায়ে পা বাধিয়ে ঝগড়া করার চেষ্টা। কিন্তু আমাদের দলের নেতাকর্মীরা ফাঁদে পা না দিয়ে নীরবে সব সহ্য করছেন। আমরা চাই শুধু এটা দেখাতে যে বর্তমান সরকারের একনায়কতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন সাধারণ মানুষ। শনিবারের গণসমাবেশ হবে বরিশালের ইতিহাসের সর্বকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশ।’
বিএনপি নেতাদের এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ-সদস্য অ্যাড. তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘লোক জড়ো করতে পারবে না বুঝেই এসব মিথ্যা অভিযোগ করছেন বিএনপি নেতারা। লঞ্চ, বাস, থ্রি-হুইলার ধর্মঘট কি আমরা ডেকেছি? এসব তো পেশাজীবী সংগঠনগুলোর ব্যাপার। তারা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ে ধর্মঘট ডেকেছে। এরা তো আমাদের বিরুদ্ধেও ধর্মঘট ডাকে।’
সব ধরনের গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ থাকার পাশাপাশি বরিশাল নগরীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে পুলিশি অভিযানেরও অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতারা। বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক বলেন, ‘আবাসিক হোটেলগুলোতে দূরদুরান্ত থেকে আসা আমাদের নেতাকর্মীরা অবস্থান করছেন। ভাড়া দিয়ে থাকছেন তারা। অথচ সেখানেও অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।
গণসমাবেশ বানচালে সবরকম আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা চলছে। বরিশাল নগরী, বানারীপাড়া, উজিরপুর, বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালী এবং ভোলার চরফ্যাশনসহ বিভিন্ন স্থানে আমাদের গণসংযোগে হামলা করা হয়েছে। এমনকি নেতাকর্মীদের হাত-পা ভেঙে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশালের পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আবাসিক হোটেলের বর্ডারদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া আমাদের একটি রুটিনওয়ার্ক। এটা পুলিশ নিয়মিত করে। এখনো করছে। উনারা (বিএনপি) বলুক যে তাদের কোনো নেতাকর্মীকে গ্রেফতার কিংবা হোটেল থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে কিনা। অযথা অভিযোগ করলে তো আর হবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমাদের যা করা দরকার তাই করছি।’
বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে বরিশাল থেকে দেশের সব স্থানে মাইক্রোবাস চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সন্ধ্যা ৭টায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বরিশাল জেলা মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সদস্য মো. ফরিদ। তিনি বলেন, রাত ১২টার পর থেকে বরিশাল থেকে সব স্থানে মাইক্রোবাস চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের কোনো স্থান থেকে বরিশালে মাইক্রোবাস আসবে না। ৫ নভেম্বর পর্যন্ত মাইক্রোবাস বন্ধ থাকবে। বন্ধের কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।