স্টাফ রিপোর্টার: ফের বাড়লো খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম। এবার বাড়ানো হয়েছে ৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে চলতি বছরে দুই মাসের ব্যবধানে তিন দফায় ১৫ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ালো সরকার। এভাবে দাম বাড়ানোর ঘটনা নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সরকারের এমন সিদ্ধান্তে সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর আগেও নির্বাহী আদেশে দুই দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। বর্ধিত এই দাম আজ থেকে কার্যকর হবে। গত ৩১ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগ পাইকারি ও খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই দাম ফেব্রুয়ারি থেকেই কার্যকর হয়। এর আগে ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রসঙ্গত. বিইআরসি গত বছরের ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ায়। তখন ইউনিটপ্রতি ৫.১৭ টাকা থেকে এক লাফে গড়ে ১৯.৯২ শতাংশ বাড়িয়ে ৬.২০ টাকা দাম নির্ধারণ করেছিল।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মঙ্গলবার বলেন, এই দাম বৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষের সক্ষমতা আরও কমবে। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের ভর্তুকি হয়তো কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বাড়বে। এছাড়া বাড়বে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন খরচ। ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। মির্জ্জা আজিজ বলেন, এতে আরেকটি সমস্যা হবে। পণ্যের উৎপাদন খরচ যতোটা বাড়বে, ব্যবসায়ীরা দাম তার চেয়ে আরও বেশি বাড়িয়ে দেবে। এমনিতেই ক্ষুদ্র আয়ের মানুষ বিপদে রয়েছে। নতুন সিদ্ধান্তে আরও বিপদে পড়বে।
মির্জ্জা আজিজ মনে করেন, বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে বিকল্প পদক্ষেপ নেওয়া যেত। সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা এবং দুর্নীতি কমালে দাম সমন্বয় হতো। সেটি না করে জনগণের ওপর দায় চাপানো হয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নে সরকার একের পর এক পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়িয়ে যাচ্ছে। আগে দাম বাড়ানোর এই প্রক্রিয়া থেকে হতদরিদ্র ও কৃষি-সেচকে বাদ রাখা হতো। এখন সেখানেও হানা দিচ্ছে সরকার। সাত মাসে ৮ বার বাড়ানো হয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, তেল ও সারের দাম। এর প্রভাবে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে একদিকে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। টাকার মান কমে গিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে গিয়ে মান কমে যাচ্ছে। ব্যয় ভারে সংকুচিত হয়ে পড়ছে মানুষের জীবন। একই সঙ্গে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৪ টাকা ১৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৩৫। শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৮৫ পয়সা এবং ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ৩১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬৩ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৯৫ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৯৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ৩৪ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ১০ টাকা ৯৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৫১ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপর বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে বেড়ে ১৩ টাকা ২৬ পয়সা করা হয়েছে।
আবাসিক গ্রাহক ছাড়াও বেড়েছে সব ধরনের বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে কৃষি, ধর্মীয়, দাতব্য, হাসপাতাল, রাস্তার বাতি, পানির পাম্প, ক্ষুদ্র শিল্প, শিল্প, বাণিজ্য, ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনের বিদ্যুতের দাম বেড়েছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কৃষিকাজে ব্যবহৃত পাম্পের গ্রাহকরা এখন থেকে ইউনিটপ্রতি ৪.৮২ টাকা হারে বিল দিতে হবে। আগে এই হার ছিল ৪ টাকা ৪৯ পয়সা। ক্ষুদ্র শিল্পে ৯.৪১ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯.৮৮ টাকা। শিক্ষা, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালে ৬.৬৪ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬.৯৭ টাকা। রাস্তার বাতি ও পানির পাম্প ব্যবহারকারী গ্রাহকদের জন্য ৮.৪৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮.৯১ টাকা। নির্মাণ শিল্পে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুৎ বিল ১৩.২৩ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩.৮৯ টাকা। ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকদের জন্য বিদ্যুতের দাম ৮.৮২ টাকা থেকে বাড়িয়ে (ফ্ল্যাট) ৮.৮৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে পিক আওয়ারে এই বিল দিতে হবে ১১.০৬ টাকা হারে। সুপার অফ-পিকে যারা ব্যবহার করবে তাদের জন্য এই রেট ৭.০৮ টাকা। বাণিজ্যিক অফিসে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকদের জন্য ১১.৩৬ (ফ্ল্যাট) টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১১.৯৩ টাকা।
এর আগে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি যে ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল তখন শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহৃত গ্রাহকরা ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতেন ৩.৯৪ টাকা। এছাড়া শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত ৪.৪০ টাকা। ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট পর্যন্ত ছিল ৬.০১ টাকা। ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত ৬.৩০ টাকা। ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত ৬.৬৬ টাকা। ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিট পর্যন্ত ১০.৪৪ টাকা। ৬০০ ইউনিটের ঊর্ধ্বে ব্যবহৃত গ্রাহকদের জন্য রেট ছিল ১২.০৩ টাকা। এছাড়া কৃষি ৪.৩৭ টাকা, ক্ষুদ্র শিল্পে ৮.৯৬ টাকা, নির্মাণ শিল্পে ১২.৬০ টাকা। বাণিজ্যিক ও অফিস ১০.৮২ টাকা ও শিল্পে ৮.৮৯ টাকা ছিল ইউনিটপ্রতি।