স্টাফ রিপোর্টার: ছুটির দিনে ঘুরতে বেরিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ১১ শিক্ষক-শিক্ষার্থী। নিহতরা সবাই ওই উপজেলার আমানবাজার এলাকার বাসিন্দা। মাইক্রোবাসচালক ছাড়া বাকিরা স্থানীয় আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের ছাত্র ও শিক্ষক। চাঁদা তুলে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনায় পিকনিক করতে গিয়েছিলেন তারা। শুক্রবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে মিরসরাইয়ের বারতাকিয়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাদের বহনকারী মাইক্রোবাস। এতে ১১জন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৫ জন। এ ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন-মাহিন (১৮), তানভীর হাসান (১৮), জুনায়েদ হোসেন (১৮), জিয়াউল হক সজীব, মোছহাব আহমেদ হিসাম, (১৯) ও মাইক্রোবাসচালক গোলাম মোস্তফা নিরু (২৮)।
জানা গেছে, শুক্রবার সকাল ৮টায় আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ ১৬জন হাটহাজারীর আমানবাজার থেকে মাইক্রোবাসযোগে খৈয়াছড়া ঝরনায় ঘুরতে যান। ঘোরাঘুরি শেষে ফেরার পথে দুপুর পৌনে ২টার দিকে বারতাকিয়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেয় চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী ট্রেন। এতে ঘটনাস্থলেই ১১ জন নিহত হন। আহত হন আরও পাঁচজন। তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থী কাজী এম সাজিদ বলেন, ‘আমানবাজার এলাকার যুগিরহাটে আমাদের কোচিং সেন্টারটি অবস্থিত। কোচিং সেন্টারের ১৬ শিক্ষক-শিক্ষার্থী খৈয়াছড়া ঝরনাসহ মিরসরাইয়ের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র দেখতে ৫০০ টাকা করে চাঁদা তুলেছিলেন। এর মধ্যে চারজন শিক্ষক ছিলেন। তারা হলেন- জিসান, রিদুয়ান, সজিব ও রাকিব। বাকিরা শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছয়জন এসএসসি পরীক্ষার্থী, বাকি চারজন একাদশ শ্রেণির ছাত্র। একজন মাইক্রোবাসের চালক, অপরজনের পরিচয় আমার জানা নেই। ১৬ জনের মধ্যে ১১ জন নিহত হয়েছেন। পাঁচজন আহত হয়েছেন।’
চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ সুপার মো. হাসান চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত হয়েছেন। ধাক্কা দিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার মাইক্রোবাসটি নিয়ে গেছে ট্রেনটি। সেটি উদ্ধার করা হয়েছে।’
ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে ১১ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। পাঁচজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মাইক্রোবাসটি উদ্ধার করা হয়েছে। এতে ১৬ জন যাত্রী ছিলেন। এর মধ্যে ১১ জন নিহত হয়েছেন।’
ক্রসিংয়ের গেটম্যান আটক: এদিকে, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ আরোহী নিহত হওয়ার ঘটনায় ওই ক্রসিংয়ের গেটম্যান মো. সাদ্দামকে আটক করেছে রেলওয়ে পুলিশ। শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে রেলক্রসিং এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘সাদ্দামকে আটক করা হয়েছে।। দুর্ঘটনার বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
রেলের তদন্ত কমিটি গঠন: এদিকে, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার বিকেলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহণ কর্মকর্তা (ডিটিও) মো. আনছার আলীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। কমিটির অপর চার সদস্য হলেন- বিভাগীয় নির্বাহী প্রকৌশলী-১ আবদুল হামিদ, বিভাগীয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (লোকো) জাহিদ হাসান, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ড্যান্ট রেজানুর রহমান এবং বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার (ডিএমও) মো. আনোয়ার হোসেন।
জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘দুর্ঘটনার বিষয়টি তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।’ চমেক হাসপাতালে স্বজনদের আর্তনাদ।
এদিকে, মিরসরাইয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। কারও মা-বাবা, কারও ভাই এবং কারও বন্ধু-স্বজনদের কান্না-আর্তনাদে হাসপাতাল এলাকায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। দুর্ঘটনায় নিহত জিয়াউল হক সজীবের বাবা আবদুল হামিদ বলেন, ‘৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সজীবসহ তিন বন্ধু মিলে এ কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। চার মাস আগে এ কোচিং সেন্টার করে তারা। এখনও ওই টাকা পরিশোধ করা হয়নি। সজীব সকাল সাড়ে ৭টায় পিকনিকে যায়। সে সময় আমার সঙ্গে কথা হয়। ছেলে আমার থেকে দোয়া নিয়ে গেছে। দুপুর ২টার দিকে খবর আসে তাদের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছে।’
ছেলের জন্য বিলাপ করতে করতে এই বাবা বলেন, ুআমি মুদির দোকানে চাকরি করি। আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে। সজীব সবার বড়। সজীব ওমরগনি কলেজে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর অনার্সে ভর্তি করা হয়। এখনও অনার্স শেষ হয়নি। অভাবের কারণে তাকে লেখাপড়ার খরচ দিতে পারিনি। আমার ছেলে টিউশনি করতো।’
এ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন মোছহাব আহমেদ হিসাম নামে এক ছাত্র। হিসাম ওই কোচিং সেন্টারের ছাত্র। হাটহাজারী উপজেলার কেএস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল সে। তার মৃত্যুতে হাসপাতাল এলাকায় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন স্বজনরা। বাবার মৃত্যুর পর হিসাম চাচা মানিকের কাছে থেকে বড় হয়েছেন। চাচা মানিক বলেন, ‘আমি তার মাকে কী জবাব দেবো?’
নিহত মাহিনের চাচা আলাউদ্দিন টিপু বলেন, ‘সকালে বন্ধু ও শিক্ষকরা মিলে মাইক্রোবাসে খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে যায়। ফেরার পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় মাহিনসহ ১১ জন মারা যান। তাদের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিকেল কর্মকর্তা নিবেদিতা ঘোষ বলেন, ‘মিরসরাইয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত পাঁচজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে চারজন এবং ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে একজনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।’