ভাড়া পুনঃনির্ধারণে মালিক-শ্রমিক সাথে বিআরটির বৈঠক আজ
স্টাফ রিপোর্টার: গণপরিবহনের ভাড়া বাড়াতে গতকাল শীনবারও যাত্রীদের জিম্মি করে ধর্মঘট অব্যাহত রেখেছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের আকস্মিক এ ধর্মঘটে সারা দেশে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। বন্ধ রয়েছে দূরপালস্নার বাস, ট্রাক, লরি, কার্গো এবং কাভার্ডভ্যান। অনির্দিষ্টকালের পরিবহণ ধর্মঘটে অফিসগামীসহ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। ধর্মঘটের কারণে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটে চলা মানুুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। গণপরিবহণ না থাকায় বিকল্প মাধ্যমে দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া হাঁকা হচ্ছে। প্রয়োজনে ঘর থেকে মানুষের রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা দেখা গেছে। এদিকে ধর্মঘটের নামে যাত্রী জিম্মি করার দায় নিচ্ছে না কেউ। পরিবহন মালিক সমিতি নেতৃবৃন্দ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও তাদের প্রত্যক্ষ মদদে সারা দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি বলছে, জ্বালানি তেলের দাম ২৩% বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন তারা। গণপরিবহন না পেয়ে সাধারণ মানুষকে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে দেখা গেছে। এদিকে গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে লঞ্চ চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছেন লঞ্চ মালিকরা। তারাও শতভাগ ভাড়া বাড়ানোর দাবি তুলেছেন। গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের ব্যাপারে আজ পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বিআরটিএ কর্মকর্তা। পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের দাবি, হয় তেলের দাম কমাতে হবে, অন্যথায় পরিবহণে ভাড়া সমন্বয় করতে হবে। ভাড়া বাড়ানো না হলে তারা রাস্তায় পরিবহণ নামাবেন না। বিআরটিএ সূত্র জানায়, আজ রোববার বিআরটিএর ভাড়া পুনঃর্নিরধারণ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বাস্তবভিত্তিক মূল্য সমন্বয়ের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে চেষ্টা করা হবে।
এদিকে গত দুদিন ধরে পরিবহণ না চলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল পরিবহণ ও রপ্তানমিুখী পণ্য পরিবহণে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি ও ট্রাক ভাড়া বাড়ায় দাম ক্রমশ বাড়ছে। এ ছাড়া সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পোশাক শিল্পে। সময়মতো পণ্য ডেলিভারি দিতে না পারলে ক্রেতারাও খুঁজবে বিকল্প পথ। তাই অনতিবিলম্বে সরকারকে পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে বিষয়টি নিষ্পত্তির জানিয়েছেন পোশাক শিল্পের দুই শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা। শিল্প মালিকরা বলছেন, এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে বড় সংকট দেখা দিতে পারে দেশের পোশাকশিল্পসহ রপ্তানিমুখী সব খাতে। এদিকে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, বান্দরবানসহ নানা পর্যটন স্পটে আসা কয়েক হাজার পর্যটক ধর্মঘটের কারণে বাস না পেয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া আমদানি-রপ্তানি বন্দরগুলোয়ও দেখা দিয়েছে পণ্যজট। পাশের দেশ থেকে যাত্রীদের দেশে আসতেও পোহাতে হচ্ছে বিড়ম্বনা।
নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা সচল রাখার স্বার্থে জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্য পরিহার ও পরিবহণ ধর্মঘট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গণপরিবহণ বন্ধে শুধু দূরের যাত্রীদের নয়, ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে রাজধানীর অফিসগামী অসংখ্য মানুষকে। বাস না থাকায় বিকল্প হিসেবে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশাযোগে অফিসে যেতে হচ্ছে তাদের। আবার এসব বাহন সংকটে অনেককে হেঁটেও গন্তব্যে যেতেও দেখা গেছে। এভাবে অফিস যেতে কয়েকগুণ বেশি খরচের পাশাপাশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অনেকে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্যবস্থায় কর্মীদের পরিবহণের ব্যবস্থা করলেও বেশিরভাগ অফিসগামী মানুষকে ভোগান্তি নিয়ে অফিসে ছুটতে হয়েছে।
গতকালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজধানীর সাত সরকারি কলেজের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা ছিল। সকাল ১০টায় শুরু হয়ে পরীক্ষা চলে ১১টা পর্যন্ত।
এদিকে লঞ্চ পরিচালন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও লঞ্চের ভাড়া বহুদিন বাড়ানো হয়নি। এমভি টিপু লঞ্চের পরিচালক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, ডিজেলের দাম বাড়লেও লঞ্চের ভাড়া বাড়েনি। তাই এবার ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে তারা লঞ্চ চলাচল বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাপ) সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো প্রস্তাবে ব্যবসায় টিকে থাকার লক্ষ্যে বর্তমান ভাড়ার ওপর ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ১.৭০ টাকার স্থলে ৩.৪০ এবং ১০০ কিলোমিটারের ঊর্ধ্বে ১.৪০ টাকার স্থলে ২.৮০ টাকা নির্ধারণ করার দাবি জানান তারা।
গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় মানুষ গত দুদিন ধরে ভোগান্তিতে। এ অবস্থায় কেউ কেউ বিকল্প ব্যবস্থায় গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এসব যাত্রী জানান, এ দেশে যার যাই প্রয়োজন হক না কেন, দাবি আদায়ে সাধারণ মানুষকেই জিম্মি হতে হয় বারবার। পরিবহণ মালিকরাও বরাবরই মানুষকে বিপদে ফেলে তাদের আখের গোছান।
বাস মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলো বলছে, সরকার তাদের দাবি না মানলে ধর্মঘট চলবে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় মালিকরা ঝুঁকি নিয়ে বাস চালাতে চাচ্ছেন না। তাদের দাবি গত কয়েক বছর ধরে সরকার ভাড়া বাড়াচ্ছে না। যন্ত্রপাতির দাম বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খাতে ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ জন্য নতুন করে ভাড়ার সমন্বয় চাচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ জানান, তার সংগঠন থেকে ধর্মঘট ডাকা হয়নি। পরিবহন মালিকরা চলমান ভাড়ায় গাড়ি চালাতে চাচ্ছেন না। তেলের দাম বাড়ায় এই সময় তারাও বিপাকে পড়েছেন। তিনি বলেন, বাস চালাতে আমরা বিআরটিএর সঙ্গে বৈঠক করতে চেয়েছি। তাদেরকে আমরা চিঠি দিয়েছি। আজ রোববার বিআরটিএর সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে আমাদের দাবি মানা হলে পরবর্তীতে বাস চলবে। বৈঠক চলাকালীন সময়েও বাস চলাচল বন্ধ রাখবে মালিকরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, মালিকরা বাস বন্ধ রেখেছে। আমরা চাচ্ছি দ্রুত এর একটা সমাধান হোক। বিআরটিএর সঙ্গে আমরা প্রথম দিন থেকেই বৈঠক করে ভাড়া সমন্বয়ের কথা বলে আসছি। বিআরটিএ আমাদেরকে রোববার সময় দিয়েছে। আমার সংগঠনের মহাসচিব বৈঠকে অংশ নেবেন। আমরা চাই একটা সমাধান আসুক। দেশের মানুষের কষ্ট লাঘব হোক। জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। ভারতও তেলের দাম কমিয়েছে। আমাদের দেশে বাড়ছে। এতে জনজীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে। সব কিছুর ওপর এর প্রভাব পড়বে।
অন্যদিকে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ পণ্য পরিবহন খাতটি কখনো সরকারি ভাড়া নির্ধারণের আওতায় নেই। তারা দরকষাকষি করে প্রতিযোগিতামূলক ভাড়ায় পণ্য পরিবহন করে। তারাও এবারের ধর্মঘটে শামিল হয়ে তেলের বাড়তি দাম প্রত্যাহারের দাবি তুলছে। গতকাল সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে দেখা করে এসে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির নেতারা দাবি মানা না হলে ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে বলে জানান। সংগঠনের অতিরিক্ত মহাসচিব আবদুল মোতালেব জানান, তেলের দাম প্রত্যাহারের দাবিতে দেওয়া ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে তাদের দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।