স্টাফ রিপোর্টার: প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে ‘সার্চ কমিটি’র কাছে নির্ধারিত সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ২৬টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নাম জমা দিলেও সাড়া মেলেনি বিএনপিসহ ১৩ দলের। নাম জমা না দেয়ার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছে দলগুলো। তাদের ভাষায়, সার্চ কমিটির কোনো মূল্য নেই। সার্চ কমিটির কাছে নাম দেওয়া অর্থহীন। আবারও সরকারের অনুগতদের নিয়েই মেরুদ-হীন ইসি গঠন করা হবে। নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ প্রশাসন ছাড়া দেশে কোনোভাবেই অবাধ, সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব নয়। সরকার আবারও ক্ষমতায় থাকার জন্য ইসি গঠন নিয়ে সব করছে।
জানা গেছে, সার্চ কমিটি গঠনের এক সপ্তাহের মাথায় প্রস্তাবিতদের নাম সংগ্রহ শেষ হয় শুক্রবার। এরপর শনি ও রোববার বিশিষ্টজনের মতামত নেয় সার্চ কমিটি। তবে রবিবার বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সার্চ কমিটির কাছে নাম প্রস্তাবের জন্য সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়। সে সময় গতকাল শেষ হয়েছে। তবে আগের ২৪ রাজনৈতিক দলের পর গতকাল মাত্র দুটি দল নতুন করে নাম জমা দিয়েছে। কিন্তু বিএনপিসহ বাকি ১৩ দল নাম প্রস্তাব করেনি।
নির্ধারিত সময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ৩২২ ব্যক্তির নাম জমা পড়ে সার্চ কমিটিতে। গতকাল সে নাম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে কমিটি। যদিও তালিকায় কয়েকজনের নাম একাধিকবার ছিল। আজ আবারও বিশিষ্টজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করবে সার্চ কমিটি। সেখানেও নতুন নামের প্রস্তাব আসতে পারে। সার্চ কমিটিতে নাম না দেয়ার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটি সম্পূর্ণ অর্থহীন। বিগত দুটি নির্বাচনের আগে যেভাবে ইসি গঠন করা হয়েছে, একইভাবে আবারও একটা খোলস লাগিয়ে তারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে চাইছে। তিনি বলেন, ‘লোক দেখানো সংলাপ করা হয়েছে। দেখানো হচ্ছে যে সবার মতামত নিয়ে কী সুন্দরভাবে এ কমিশন গঠন করছি! দেখা যাবে যে সেই নূরুল হুদার মতো লোকজনকেই তারা নির্বাচিত করবে। তা ছাড়া এ সার্চ কমিটির বেশির ভাগ সদস্যই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একজন আছেন, যিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পর্যন্তও চেয়েছিলেন। কাজেই আমাদের কাছে সার্চ কমিটির কোনো মূল্য নেই। তাদের কাছে নাম দেয়াটা সম্পূর্ণ ‘অর্থহীন’। এজন্য বিএনপি নাম দেয়নি।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, ‘যদু-মধু যদি নাম চায়, তা-ই দিতে হবে? যার কোনো অধিকার নেই। নির্বাচন কমিশনে কারা থাকবেন, তা নির্ধারণ করবে কে? সার্চ কমিটি, না প্রধানমন্ত্রী?’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দেবেন একে একে ইসিতে নিয়োগ দেয়া হোক। সে অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন। আমরা তো সরকারের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন কমিশন চেয়েছিলাম। এজন্য একটি আইন করতে বলেছিলাম। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এত অল্প সময়ে আইন করা যাবে না। তারপর আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে বিদ্যুৎগতিতে এমন একটি আইন করল, যেটার মধ্যে সরকারের হাতেই চূড়ান্ত দায়িত্ব থেকে গেল। সুতরাং এটা তো অর্থহীন।’ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, সার্চ কমিটির কাছে নাম দেয়া অর্থহীন। এদের কোনো এখতিয়ার নেই। তিনি বলেন, ইসি নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে রাখার বিষয়টাই আইনসিদ্ধ করা হয়েছে। ইসি নিয়োগের আইন সংস্কার প্রয়োজন।
জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ প্রশাসন ছাড়া দেশে কোনোভাবেই অবাধ, সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব নয়। ইসি গঠন নিয়ে যা হচ্ছে, সবই ২০১৪ ও ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য যা যা করেছিল, এবারও সেগুলোই করছে। কাজেই এগুলো সবই অর্থহীন। এজন্য নাম দিইনি।’
এলডিপি প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বীরবিক্রম বলেন, ‘এ সরকার সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করে ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশে এখন আর এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যা নিরপেক্ষ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তারা আওয়ামী সংগঠনে পরিণত করেছে, যে কারণে আমরা জাতীয় সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছি। জাতীয় সরকার এসেই এসব দলীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানকে নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করবে। তবেই দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন সম্ভব হবে। এজন্য সার্চ কমিটিতে নাম দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক বলেন, ‘ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ থেকে শুরু করে সার্চ কমিটি গঠন পর্যন্ত সবকিছুই সময়ের অপচয় এবং অপ্রয়োজনীয়। নির্বাচন কমিশনকেন্দ্রিক এবং সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক যে সংকট বিদ্যমান, এভাবে এর সমাধান হবে না। সমাধানের কোনো পথও বের হবে না। এবারও এ সংলাপ এবং এরপর সার্চ কমিটির মাধ্যমে অকার্যকর, মেরুদ-হীন ও সরকারের অনুগতদের নিয়েই ইসি গঠন করা হবে, যা দেশের বিদ্যমান সামগ্রিক সংকট আরও প্রকট করে তুলবে। এজন্য নাম দিইনি।’
বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, ‘দেশের সুশীল সমাজ ও পেশাজীবীদের কারও পরামর্শ না নিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইসি আইন ও সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নেই। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও নিজেদের মধ্যে চর দখলের মতো হানাহানি হয়েছে। কাজেই সব শ্রেণির মানুষকে যুক্ত না করে যত ভালো মানুষকেই বসানো হোক না কেন, তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সার্চ কমিটির এ প্রক্রিয়া সরকারের প্রতি অনাস্থা আরও বাড়াবে। আর জনগণের কাছে যা গ্রহণযোগ্য নয় তার সঙ্গে আমরাও নেই।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠনে সরকার যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে তা অগ্রহণযোগ্য। নতুন ইসি গঠনে সার্চ কমিটি জনগণের আশা পূরণ করতে পারবে না। সার্চ কমিটিতে যারা রয়েছেন তারা নিরপেক্ষ নন। তাই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সার্চ কমিটিতে নাম দেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘চলমান সংকট দূর করতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে একটি কার্যকর সংলাপ এখন সময়ের অনিবার্য দাবি।’
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, ‘যখন বঙ্গভবনে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলাম, তখন প্রস্তাব করেছিলাম সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ আংশিকভাবে সংশোধন করতে, যেন রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়াই নিজ বিবেচনায় একটি স্বাধীন শক্তিশালী নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারেন। এখন আমরা নাম দিলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ। এ পরামর্শ অবশ্যই রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনায় হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। দেশ, দল ও জোটের বিবেচনায় আমরা নাম দিইনি সার্চ কমিটিতে। কারণ দেশ, দল ও জোটে একেক সময় একেক বিষয় প্রাধান্য পায়।’
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, ‘সার্চ কমিটিতে নাম দেয়ার চিঠি পেয়েছি ৯ তারিখ সন্ধ্যায়। ১১ তারিখ বিকাল ৫টার মধ্যে নাম দিতে হবে। এ অল্প সময়ে ফোরামের বৈঠক করা এবং ১০ জনের নামের তালিকা করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি আমরা লিখিতভাবে জানিয়েছি। এজন্য নাম দিতে পারিনি।’