স্টাফ রিপোর্টার: নরসিংদীর দুর্গম চরাঞ্চলে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক হামলা, সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়েছে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে চারজন নিহত এবং এক মেম্বার প্রার্থীসহ অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছেন। গুরুতর আহত ১০ জনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এ সময় বেশ কয়েকটি বাড়িঘরে ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার ভোরে সদর উপজেলার মেঘনা নদীবেষ্টিত চরাঞ্চল আলোকবালী ইউনিয়নের নেকজানপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ তাহের নামে একজনকে হাসপাতাল থেকে আটক করেছে। তবে রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
এদিকে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনায় পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ করেছেন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মামুন হাসান। তিনি বলেন, হামলা হতে পরে, এ বিষয়টি পুলিশকে জানালেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
নিহতরা হলেন নেকজানপুর গ্রামের কটুমিয়ার ছেলে আমির হোসেন (৪৫), একই গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলে আশ্রাফুল (২২), আব্দুল মনু মিয়ার মেয়ে খোরশেদা বেগম খুশি (৫০) ও শহিদুল্লাহ মিয়ার ছেলে খায়রুল ইসলাম (৩০)। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন: খায়রুল, বাদশা মিয়া, আবুল খায়ের, হানিফ, আনিস মিয়া, আব্দুল লতিফ, আহসানুল্লাহ, শউকত মিয়া, আরিফ, সনিয়া, মমিন আলী, মাসুমা, মকবুল হোসেন, আকাশ, জিয়াউর, হাসেম, মিজান ও বুলু।
পুলিশ জানিয়েছে, আলোকবালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দীপু এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুল্লাহ আসাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ ছিল। ১১ নভেম্বর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ বিরোধ আরও বাড়ে। এর জেরে ১০ দিন আগেও দুপক্ষের মধ্যে সংষর্ষ হয়েছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান বর্তমান চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দীপু। নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন আসাদুল্লাহ। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে দলীয় নেতাকর্মীদের চাপে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। বিষয়টি নিয়ে আসাদুল্লাহ সমর্থক মেম্বার প্রার্থী রিপন মোল্লা ও দীপু সমর্থক মেম্বার প্রার্থী আবু খায়েরের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এরই জেরে বৃহস্পতিবার ভোরে রিপন মোল্লার সমর্থকরা টেঁটা, বল্লম ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নেকজানপুর গ্রামে আবু খায়ের সমর্থকদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। পরে উভয় পক্ষের সংঘর্ষে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন আমির হোসেন, আশ্রাফুল ও খোরশেদা বেগম খুশি। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকায় নেওয়ার পথে মারা যান খায়রুল। সংঘর্ষে ১০ গুলিবিদ্ধসহ কমপক্ষে ৪০ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ সবাইকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অপর আহতদের নরসিংদী সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ ঘটনায় নেকজানপুর গ্রামে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে।
নিহতদের মধ্যে খুশি ছাড়া সবাই আলোকবালী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দীপুর সমর্থক। তবে প্রতিপক্ষ অ্যাডভোকেট আসাদুল্লাহ আসাদ দাবি করেন, আমির হোসেন তার আত্মীয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আলোকবালী ৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মামুন হাসান বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটেতে পারে, তা আমরা আগেই টের পেয়েছিলাম। তাই পুলিশকে জানিয়েছি। তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এজন্য পুলিশের অবহেলাই দায়ী।
নিহত খোরশেদা বেগমের ছেলে মাইন উদ্দিন বলেন, আমাদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের জয়নগর গ্রামে। মামাতো ভাই অসুস্থ। তাই বৃহস্পতিবার মামার বাড়িতে আসেন মা। ভোরে হামলাকারীরা যখন মামাকে মারধর করেছিল, তখন আমার মা বাধা দিতে গেলে তার বুকে গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। পরে মামাকেও গুলি করে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় হামলাকারীরা।
টেঁটাবিদ্ধ হয়ে আহত প্রত্যক্ষদর্শী মমিন আলী বলেন, সকালে হঠাৎ গুলির শব্দ। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, কাইয়ুম ও রিপনের নেতৃত্বে¡ শত শত লোক অস্ত্র নিয়ে মানুষের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় আনেক বাড়িঘরে ভাঙচুর ও আগুন দেয় তারা।
আলোকবালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলায়ার হোসেন দীপু বলেন, নির্বাচনে আসাদুল্লাহ আমাকে সর্মথন জানিয়ে মনোনয়ন তুলে নিয়েছিলেন। ভেবেছিলাম তারা আমার সঙ্গে মিলে গেছে। কিন্তু না, তারা আমাকে মেনে নিতে পারছেন না। তাই তারা নানা অজুহাতে আমার সমর্থকদের ওপর হামলা চালায় এবং ৪ জন হত্যা করে। আমি এর বিচার চাই। আলোকবালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুল্লাহ বলেন, এই সংঘর্ষে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমি দীপুকে সমর্থন জানিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছি। গ্রামে বিবাদ যেন না হয়, এজন্য ঊর্ধ্বতন নেতাকর্মীসহ পুলিশের সঙ্গে বসেছি। তাদের সহযোগিতাও চেয়েছি। কিন্তু দুই মেম্বার সমর্থকরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
নরসিংদী সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সৈয়দ আমীরুল হক শামীম বলেন, গুলি ও টেঁটাবিদ্ধ অন্তত ২২ জনকে আমরা চিকিৎসা দিয়েছি।
নরসিংদী অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাহেব আলী পাঠান বলেন, আলোকবালীতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপের দ্বন্দ্ব চলছিল। ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এটি আরও প্রকট হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দুপক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। বর্তমানে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।