ধ্বংসস্তূপ ঘিরে ব্যবসায়ীদের হাহাকার, খুঁজে পাওয়া যায়নি বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুনের উৎস

প্রধানমন্ত্রী নিজেই মনিটরিং করছেন : কারণ অনুসন্ধানে দুই তদন্ত কমিটি : নতুন করে মার্কেট নির্মিত হবে

স্টাফ রিপোর্টার: ব্যবসায়ীদের চাপা কান্না আর হাহাকারে ভারি হয়ে আছে বঙ্গবাজারের বাতাস। আদর্শ, মহানগরী, গুলিস্তান ও বঙ্গ হকার্স-এই চার মার্কেট নিয়ে ছিলো বঙ্গবাজার। গত পরশু মঙ্গলবারের আগুনে ঢাকার এই জনপ্রিয় কাপড়ের মার্কেট পুরোপুরি পুড়ে মাটিতে মিশে গেছে। সারি সারি দোকানের পরিবর্তে এখন সেখানে পড়ে আছে কয়লা। সঙ্গে আছে পোড়া কাঠ, টিন ও লোহালক্কর। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা বঙ্গবাজার মার্কেটটি এখন পুড়ে যাওয়া বিশাল ধ্বংসস্তূপ। এই ধ্বংসস্তূপে আধপোড়া পোশাকও আছে। বিক্রয়যোগ্য কোনো কাপড় পাওয়ার সম্ভাবনাই নেই। তবুও যদি কিছু অক্ষত মেলে-এই আশায় আংশিক পোড়া কাপড়চোপড় হাতড়ে দেখছেন অনেক ব্যবসায়ী। পোড়া টিন, সাটার উল্টেপাল্টেও দেখছিলেন কেউ কেউ। তাদের চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের সামনেই বসে রয়েছেন অনেকেই। তাদের সামনেই টোকাইরা পোড়া কাপড়, টিন, লোহাসহ নানা জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। শুধু অপলক নয়নে তাকিয়ে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল বুধবার বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিনসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বঙ্গবাজারের পোড়া মার্কেটের সামনেই সাংবাদিকদের জানান, অগ্নিকান্ডের ভয়াবহতা এতটাই বিপজ্জনক ছিলো, যে আগুন কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিলো না। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের জলকামান এবং অন্যান্য বাহিনীর সহযোগিতায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। কিন্তু ততক্ষণে আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ভয়াবহ এই অগ্নিকা- থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি হলে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করবো, তা ভাববার সময় এসেছে। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবাজারের পাশেই পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। সেখানকার একটি ভবনে আগুন লেগেছিলো। আগুন যদি ছড়িয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের মূল ভবনে লাগতো তাহলে অকল্পনীয় ক্ষতি হতো। অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে মন্ত্রী আরও বলেন, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজেই মনিটরিং এবং দেখভাল করছেন। এছাড়া অগ্নিকান্ডের কারণসহ নানা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে উদ্ধারকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের রাখা হয়েছে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকেও ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির সভাপতি হলেন, লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী, পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স)। কমিটির সদস্য সচিব হলেন মো. বজলুর রশিদ, উপসহকারী পরিচালক, জোন-১, ঢাকা। অপর সদস্যরা হলেন, দিনমনি শর্মা, উপপরিচালক, ঢাকা বিভাগ। মো. শাহিন আলম, সিনিয়র স্টেশন অফিসার, সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশন ও অধীর চন্দ্র, ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর। এর আগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন আগুনের তীব্রতার বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন,  দোকানে নানা ধরনের কাপড়সহ অন্যান্য জিনিসপত্র ছিলো। শুষ্ক মরসুমের কারণে তা অতিমাত্রায় দাহ্য হয়ে ছিলো। এজন্য আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তা দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে এবং ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সৃষ্টি করে।

এদিন বেলা সাড়ে ১২টায় বঙ্গবাজার এনেক্সকো ভবনের সামনে এক ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আগুনের প্রকৃত উৎস আমরা এখনো খুঁজে বের করতে পারিনি। মালামাল বের করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে এখনো কোথাও কোথাও আগুন জ্বলছে, ধোঁয়া হচ্ছে। পুরোপুরি নেভাতে না পারলেও আগুন সম্পূর্ণরুপে আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

এদিকে, বুধবার বিকেল পৌনে ৪টা পর্যন্ত বঙ্গবাজার ও এনেক্সো মার্কেট থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট সেখানে অনবরত পানি দিচ্ছে। বঙ্গবাজার মার্কেট পুড়ে রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা মহানগর হকার্স মার্কেটেও।

এই মার্কেটটির সামনের ১০/১৫টি দোকান কোনোমতে টিকে আছে। তবে সেই টিকে থাকায় লাভ নেই। বলছিলেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, দোকানে যেসব মালামাল আছে তা আগুনের তাপে আর কালিতে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। কেউ এসব মালামাল বিনা পয়সায় দিলেও নেবে না। তাই দোকান থেকে মালামাল বের না করে বসে আছি। এমনিতেই সব শেষ তার উপর অযথা পরিশ্রম করে কোনো লাভ নেই। এসব কাপড় বের করে পরিষ্কার করারও কোনো উপায় নেই। এসব দোকানে মালামাল থাকা আর না থাকার মধ্যে পার্থক্য নেই।

মার্কেটটির দ্বিতীয় তলার দুটি দোকানের মালিক সায়েম শেখ বলছিলেন, ‘আমি পুরোপুরি পথে বসে গেছি। আমার দুটি দোকানে কমপক্ষে ৪৮ লাখ টাকার মালামাল ছিলো। সব শেষ হয়ে গেছে। কিছুই বাকি নেই। দোকান থেকে কোনো কিছুই বের করাও সম্ভব হয়নি। ৪৮ লাখ টাকার মধ্যে ৩৫ লাখ টাকাই ঋণ। এছাড়া ব্যবসায়ীদের নিয়মানুযায়ী ২০ রমজানের পর সব হিসাব হয়। কর্মচারীদের হিসাব অনুযায়ী তারা পাবে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। ঋণের ৩৫ লাখ টাকাই পাবেন সদরঘাট ও ইসলামপুরের পাইকারি কাপড় ব্যবসায়ীরা। এসব ব্যবসায়ীরা এই মুহূর্তে টাকা না চাইলেও ঈদের আগে টাকা চাইবে। এই ভেবেই পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়।’

কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সায়েম শেখ বলেন, দুটি দোকানের মধ্যে আমি একটি দোকান ৫ বছর আগে ৩৫ লাখ টাকায় কিনেছিলাম। যেহেতু জায়গাটি সরকারি, তাই সরকার যদি নিয়ে যায় এবং কোনো ক্ষতিপূরণ না দেয়, তাহলে পুরো রাস্তায় বসে যেতে হবে। অপর দোকানটি ৫ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে ভাড়া চালাচ্ছিলাম। সবমিলিয়ে টাকার হিসাবে কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আমি নিরুপায়। আমার কিছুই নেই। বলেই কাঁদতে লাগলেন এই ব্যবসায়ী। কোনো কিছুতেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছিলো না।

এদিন সরেজমিন দেখা গেছে, সাতটি মার্কেটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আর্দশ মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেট, বঙ্গবাজার মার্কেট, বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট ও মহানগর হকার্স মার্কেট ও ইসলামিয়া হকার্স মার্কেট। এছাড়া তুলনামূলক কম ক্ষতি হয়েছে এনেক্সো মার্কেট ও হোমিং কমপ্লেক্স মার্কেট। এই দুটি মার্কেটের বেশ কিছু দোকান এখনো টিকে আছে। এর মধ্যে এনেক্সো মার্কেটের চার থেকে ৬ তলা পর্যন্ত মোট তিনটি তলার প্রায় ৮০ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে তিন তলা পর্যন্ত তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে কাপড় পোড়ার কালো পানিতে বহু মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। এসব মালামাল বিক্রি করা প্রায় অসম্ভব হতে পারে বলছিলেন ব্যবসায়ীরা। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ী মো. ফারুক বলেন, বঙ্গবাজারের ১৯৮২ নম্বর আলামিন থ্রি পিস ও ২০০৮ নম্বর হৃদয় গার্মেন্টস নামে তার দুটি দোকান ছিলো। দোকানে প্রায় ৭৫ লাখ টাকার মালামাল ছিলো। আর নগদ টাকা ছিলো ৫ লাখ। অনেক রাতে দোকান বন্ধ করে নগদ টাকা নিয়ে বাসায় যাওয়া অনিরাপদ ভেবে দোকানেই প্রায় ব্যবসায়ীরাই টাকা রেখে যান। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমি এখন পথে বসে গেছি। কীভাবে ঋণের টাকা পরিশোধ করবো তা জানি না। বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন।

এদিকে, বুধবার সকাল থেকেই আশপাশের লোকজন ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ভিড়ে সেখানে তিল ধারণের জায়গা ছিলো না। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের অতিরিক্ত সদস্যরা জনতাকে আটকাতে পারছিলেন না। এরমধ্যে যেসব মার্কেটের দোকান মোটামুটি অক্ষত আছে, সেসব দোকানের মালামাল উপর থেকে গাইড ধরে ফেলে হচ্ছিল। তা নিচে রাখা ট্রাকে করে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছিলেন ব্যবসায়ীরা। ছোট বড় ২৫টি ট্রাকে করে মালামাল সরিয়ে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মঙ্গলবার আমরা বহু মালামাল ওপর তলা থেকে নিচে ফেলে দিয়েছি আগুনের পোড়া থেকে রক্ষা করতে। নিচে এসে দেখি সেসব মালামাল নেই। সব মালামাল চুরি হয়ে গেছে। মঙ্গলবার আগুন লাগার পর মার্কেটগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা মালামাল চুরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের কিছুই করার ছিলো না। কারণ আমরা কাউকে চিনতে পারিনি। বুধবারও বহু মানুষ পানিতে ডুবে থাকা ভালো কাপড় চোপড় খুজে নিয়ে গেছেন। বিশেষ করে এ অনৈতিক কাজে ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা ছিলো সবচেয়ে বেশি। এছাড়া আশপাশের কিছু লোকদের পুড়ে যাওয়া সাঁটার, গ্রিল, লোহার রডসহ নানা কিছু নিয়ে যেতে দেখা গেছে।

 

Comments (0)
Add Comment