রহমান মুকুল: পদ্মা সেতু আমাদের সবিশেষ অহংকার। আমাদের সক্ষমতার অনিরুদ্ধ স্মারক। অপ্রতিরোধ্য স্বপ্নযাত্রার দুর্লভ অর্জন। অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব বিবেচনায় এ সেতু বাংলাদেশের উন্নয়নের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে স্থাপিত দেশের দীর্ঘতম এ সেতু এখন বাংলাদেশের গর্ব। বাংলাদেশের আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থায় এ এক বিস্ময়কর অগ্রগতি।
যুগ সঞ্চিত এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন করলেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্রই বদলে দেবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবন ও কর্মের ওপর ফেলবে নানা ইতিবাচক প্রভাব। দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখবে আশাতীত। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে চলেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের পুরো জীবনযাত্রাই পালটে যাবে। পদ্মাসেতুর ফলে মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে তার অপরিসীম প্রভাব পড়বে। পদ্মাসেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে মাওয়া প্রান্তে আয়োজিত সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আবেগ, সাহসিকতা, সহনশীলতা। বাঙালি জাতির জেদ, প্রত্যয়। শেষ পর্যন্ত অন্ধকার ভেদ করে আলোর পথে যাত্রা করেছি। আমরা বিজয়ী হয়েছি। এ পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচলে অনেক স্বসস্তি ফিরেছে। নির্ঝঞ্ঝাটে যাতায়াত সম্ভব হচ্ছে। ফেরি যাত্রি ও গাড়ির অপেক্ষা করছে। এ এক অভুতপূর্ব দৃশ্য। শুধু ঢাকা যাতায়াতের ক্ষেত্রেই এর প্রভাব ইতিবাচক হয়েছে, তা নয়। ব্যবসাবাণিজ্য ক্ষেত্রেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গা *কুষ্টিয়া- মেহেরপুর-ঝিনাইদহ, মাগুরা, ফরিদপুর জেলায় এ পদ্মাসেতুর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এদিকে, চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়া-মেহেরপুর-ঝিনাইদহ জেলার মানুষ দীর্ঘদিন দ্বিতীয় পদ্মাসেতুর স্বপ্ন লালন করে চলেছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ দ্বিতীয় পদ্মাসেতুর দবিতে সরব হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে পদ্মাসেতু চালুর পর পর এ জেলাবাসী দ্বিতীয় পদ্মাসেতুর দাবি উচ্চকিত করে তুলেছে।
গত ২৫ জুন পদ্মাসেতু আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে। খুলে গেছে রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের দক্ষিণের ৮ জেলার যোগাযোগের সকল অর্গল। কিন্তু একই সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়া-মেহেরপুর-ঝিনাইদহসহ মাগুরা ও রাজবাড়ি, নড়াইল ও ফরিদপুর জেলার একাংশের মানুষ নতুন করে দ্বিতীয় পদ্মাসেতুর দাবিতে সরব হয়ে উঠেছেন। মাওয়া-পাটুরিয়াতে প্রতিশ্রুতি দ্বিতীয় পদ্মাসেতু নির্মাণ করা হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ বর্তমানের অর্ধেক সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। অর্থনৈতিক বুঁনিয়াদ হবে সুদৃঢ়।
একদিকে, কুষ্টিয়া মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা ঝিনাইদহ ও রাজবাড়ি জেলা থেকে সহজে রাজধানীতে যেতে দৌলতদিয়া পাটুরিয়া রুটের ফেরি পার হতে হয়। কিন্তু যানবাহনের চাপ থাকায় প্রায় আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘন্টা। বিশেষ করে দুই ঈদে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে। এ কারণে এই রুটে পদ্মাসেতু বা টানেল নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন এই বৃহৎ এলাকার মানুষ।
অন্যদিকে, সীমান্তবর্তী চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর প্রাগপুর ও মেহেরপুরে স্থল বন্দর হচ্ছে। যার দরুণ ঢাকার সাথে আরও দ্রুত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে। চুয়াডাঙ্গা দেশের প্রথম রাজধানী, মেহেরপুর মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অস্থায়ী সরকারের শপথের স্মারক, কুষ্টিয়া সাংস্কৃতিক রাজধানী ও রবীন্দ্র-লালনের পূণ্যভূমি। দেশের বৃহত্তম চাল উৎপাদন কেন্দ্র কুষ্টিয়ার কবুরহাট ও বৃহত্তর পাইকারি কাপড়ের বাজার পোড়াদহ। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা ও কুষ্টিয়ায় জগতি, ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ সুগার মিল, চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সীমান্তে দেশের বৃহত্তম কৃষি খামার ও বীজ প্রত্যয়ন কেন্দ্র, কুষ্টিয়ার বিস্ময়কর ক্রমবর্ধমান বিসিক নগরী দেশের অর্থনৈতিক ঐতিহ্যের অন্যতম বাহন হয়ে উঠছে। বন্যার থাবামুক্ত ও অপেক্ষাকৃত প্রাকৃতিক দুর্যোগমুক্ত জেলাগুলোতে সব ধরণের ফসলের আহ্বান। রাজধানী ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের সাথে গতিশীল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠলে এতদাঞ্চলের কৃষির অপরিমেয় সম্ভাবনা সঠিক ব্যবহার করে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করার সুযোগ রয়েছে।
সেতু বিভাগের মহাপরিকল্পনায় দ্বিতীয় পদ্মাসেতু সম্পর্কে বলা হয়েছে, দেশের মধ্য ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু জেলার পদ্মা নদী পারাপারে পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ অবস্থানের চেয়ে মাওয়া-জাজিরা অবস্থান দিয়ে বেশি সময় লাগবে ঢাকা এবং দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও নড়াইলের একাংশ, গোপালগঞ্জ, যশোর এবং মাদারীপুর জেলার দূরত্ব কমানোর জন্য পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ অবস্থানে ২য় পদ্মাসেতু নির্মাণ করা প্রয়োজন। এখন প্রশ্ন হলো-এতো সম্ভাবনা ও স্বপ্নের দ্বিতীয় পদ্মাসেতুর বাস্তবতা কত দূরে?
জানা যায়, সেতু বিভাগের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া থেকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ নৌরুটে দ্বিতীয় পদ্মাসেতু নিয়ে একাধিক সংবাদও প্রকাশিত হয়। সেসব পুতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটের আগেই দ্বিতীয় পদ্মাসেতু প্রকল্পের চূড়ান্ত জরিপ প্রক্রিয়া শেষ করতে চায় সরকার। তার পূর্বে ২০২১ সালের মে-জুন নাগাদ দ্বিতীয় সেতুর বিস্তারিত সমীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিলো। যুক্তরাজ্য, কোরিয়া ও স্পেনের তিনটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে এ সমীক্ষার কাজ করার কথা ছিলো। প্রথম পদ্মা সেতুর নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করার পর থেকেই দ্বিতীয় পদ্মাসেতুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ২৬ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশন দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর পিডিপিপি অনুমোদন করে। ছয় দশমিক এক কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ১২১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ২০১১ সালের ২৭ অক্টোবর এ পিডিপিপি অনুমোদন করে। সেতুর নির্মাণ ব্যয় বহনের জন্য ২০১১ সালের ৪ নভেম্বর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয় সেতু বিভাগের পক্ষ থেকে। দরপত্রের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০১৩ সালে দ্বিতীয় পদ্মাসেতুর কাজ শুরু হবে। এর জন্য চীনা কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জিটুজি) ঋণে সেতু নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করে। যার ফলে দ্বিতীয় পদ্মাসেতুর জন্য সরকারকে কোনো টাকা দিতে হবে না। বিল্ড, ওউন, অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওওটি)
পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে সেতুটি নির্মাণ করা হবে। যার অর্থায়ন করবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। নির্মাণ কাজ শেষ টোল থেকে সেতু নির্মাণের জন্য ব্যয়কৃত টাকা পরিশোধ করা হবে। আর প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, পিডিপিপি অনুমোদিত হয়েছে। বৈদেশিক অর্থায়নের প্রচেষ্টা গুহণ করা হয়েছে।
এত পরিকল্পনার কোনোটিই গত নয় বছরে আলোর মুখ দেখেনি। দীর্ঘ এ সময়ে সেতু নির্মাণের জন্য অর্থায়নে আগ্রহী কোনো দেশ বা সংস্থা পাওয়া যায়নি। ১৫ ডিসেম্বর সেতু বিভাগের সচিব বেলায়েত হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, প্রথম সেতু চালুর পর দ্বিতীয় সেতুর কাজ শুরুর একটি পরিকল্পনা আমাদের ছিলো। তবে সে বিষয়ে এখন আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই।
দ্বিতীয় পদ্মাসেতু বা টানেল হলে কুষ্টিয়ার খাজানগর থেকে চা’ল ও পোড়াদহের কাপড় চলে যাবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এতে বাণিজ্যিকভাবে এই এলাকার মানুষ উপকৃত হবে। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য শেষ করে বাড়িতে ফিরতে পারবেন। এমন মন্তব্য কুষ্টিয়ার পোড়াদহ এলাকার ব্যবসায়ীদের।
কুষ্টিয়া বাস মিনি বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসান আবুল সেলিম ফজল বলেন, মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের মানুষ অধিক কর্মমুখী হবেন যদি দৗলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটে দ্বিতীয় পদ্মাসেতু বা টানেল নির্মাণ করা হয়। আমরা সেতুর জন্য জোর দাবি জানায়।
চুয়াডাঙ্গা শুধু প্রথম রাজধানীই না। চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়া-মেহেরপুর মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার। মেহেরপুর তো অস্থায়ী সরকারের স্মারক বহন করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার হিসেবে শেখ হাসিনার কাছে এ বৃহত্তর এলাকাবাসীর দ্বিতীয় পদ্মাসেতুর দাবি যুক্তিযুক্ত। এটি নির্মাণ করা হলে মাত্র সাড়ে ৪ ঘন্টায় আমরা ঢাকায় যেতে পারব। ঢাকার সাথে ব্যবসা বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে বলে মন্তব্য করেছেন আলমডাঙ্গা উপজেলা লোকমোর্চার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এম সবেদ আলীর।
কেন্দ্রীয় জাসদ নেতা আনিসুজ্জামান জম বলেন, এশিয়ার বৃহত্তম চিনিকল দর্শনার কেরু এন্ড কোম্পানি, কুষ্টিয়ার জগতি সুগার মিল ও ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ সুগার মিল অবস্থিত। এছাড়া, চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ জেলার সীমানায় এশিয়ার বৃহত্তম কৃষি ফার্ম দত্তনগর ফার্ম অবস্থিত। কৃষির জন্য আমাদের বৃহত্তর এলাকা আশির্বাদ স্বরূপ। আমাদের দশের অর্থনীতি লাঙ্গলের ফলার অর্থনীতি। এ সব বিবেচনা করে কৃষিকে অধিক গুরুত্ব দিতে দ্বিতীয় পদ্মাসেতু দ্রুত নির্মাণ জরুরি।
আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজের শিক্ষক তাপস রশিদ বলেন, দর্শনা, দৌলতপুর ও মেহেরপুরে স্থলবন্দর চালু হবে শীঘ্রই। এছাড়া, একমাত্র দর্শনা- গেদে ইমিগ্রেশন হয়ে ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী ট্রেন চলাচল করে। এ সব বিষয়গুলি বিবেচনায় দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর দাবি আরও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
মেহেরপুর পল্লী বিদ্যূত সমিতির চেয়ারম্যান জিনারুল ইসলাম বিশ্বাস বলেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের সুষম উন্নয়ন ও আমাদের বেশ কয়েকটি জেলার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দৌলতদিয়া পাটুরিয়াতে সেতু বা টানেল নির্মাণ অতাযাশ্যক। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এই দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের জোর দাবি করছি। আমাদের অঞ্চলে বন্যা হয় না, আল্লাহর রহমতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই। সে কারণে আমাদের জন্য রাষ্ট্রের কখনও উল্লেখযোগ্য অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। সে কারণে এতদাঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর দাবি পূরণ করা হবে বলে বিশ্বাস করি।