স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি ভোটে যেতে চায় না। তারা সন্ত্রাস-হত্যা করে ক্ষমতায় যেতে চায়। কারণ, জানে মানুষ তাদের ভোট দেবে না। ভোট পাবে না বলে নির্বাচনে না গিয়ে সরকার উৎখাত করে বিএনপি ক্ষমতা দখল করতে চায়। গতকাল রোববার চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠের জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন। সরকারের তিন মেয়াদে চট্টগ্রামের অভূতপূর্ব উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি বন্দরনগরীর মানুষের সমর্থন চান। তিনি বলেন, আপনারাই আমার পরিবার, আপনারাই আমার সব। অতীতে আপনারাই নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। আবারও আপনাদের দোয়া, সহযোগিতা ও ভোট চাই। দেশ বাঁচাতে আগামী নির্বাচনেও আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিন। হাত তুলে ওয়াদা করুন ভোট দেবেন। এ সময় মাঠে উপস্থিত জনতা ও দলীয় নেতাকর্মী হাত উঁচু করে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। এক দিনের এ সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে যান। সেখানে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ৮৩ বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের কমিশনপ্রাপ্তি উপলক্ষে আয়োজিত ‘রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ-২০২২’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এরপর বিকেলে নগরীর পলোগ্রাউন্ড মাঠে মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের নিয়ে ২৯টি প্রকল্প উদ্বোধন এবং ৬টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর জনসভার মঞ্চে ওঠেন। বক্তৃতার শুরুতে সালাম দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘অনরা ক্যান আছন’ (আপনারা কেমন আছেন)? আপনারা ভালো আছেন তো। এ সময় তিনি এমএ হান্নান, এমএ আজিজ, এমএ ওয়াহাব, আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ চট্টগ্রামের প্রয়াত দলীয় নেতাদের স্মরণ করে তাদের ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেন।
পঞ্চাশ মিনিটের বক্তৃতায় প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা চট্টগ্রামসহ সারা দেশের উন্নয়নে তার সরকারের গৃহীত কার্যক্রমের চিত্র তুলে ধরেন। বিএনপির কঠোর সমালোচনাও করেন তিনি। ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর বিএনপির গণসমাবেশের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে এসে ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা শুরু করেছিল। তাই ১০ ডিসেম্বর বিএনপির প্রিয় দিন। এ সময় শেখ হাসিনা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পদলেহনের দোসর ছিল বলেই ১০ ডিসেম্বর তারা ঢাকা শহর দখল করতে চায়। তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করবে? তিনি একই সঙ্গে প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, আর আওয়ামী লীগ বসে থাকবে? দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে বিএনপি-জামায়াত এবং স্বাধীনতাবিরোধীরা যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য চট্টগ্রামের দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এই জনসভায় পলোগ্রাউন্ড মাঠে জনতা ও দলীয় নেতাকর্মীদের উপচে পড়া ভিড় ছিলো। সেখানে বিভিন্ন রঙের টি-শার্ট ও ক্যাপ পরে ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে সকাল থেকেই জড়ো হন নেতাকর্মীরা। শুধু পলোগ্রাউন্ড মাঠই নয়, জনসভা উপলক্ষে রঙে রঙিন হয়ে ওঠে গোটা বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। দুপুর ১২টা থেকেই শুরু হয় জনসভার আনুষ্ঠানিকতা। তবে এর আগে অর্থাৎ সকাল ৮টা থেকেই জনসভাস্থলমুখী মানুষের স্রোত শুরু হয়। দেড় লাখ মানুষ ধারণক্ষমতার পলোগ্রাউন্ড মাঠ ১২টার মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। বিকেল ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসভাস্থলে পৌঁছান। ৩টা ৪৫ মিনিটে তিনি বক্তব্য শুরু করেন। ৪টা ৩৫ মিনিটে বক্তব্য শেষ করেন প্রধানমন্ত্রী। পলোগ্রাউন্ড মাঠে সর্বশেষ ২০১২ সালের ২৮ মার্চ ১৪ দলের এক জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন শেখ হাসিনা। এরপর দীর্ঘ বিরতি। তবে বিএনপি তাদের ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেড় মাস আগে ১২ অক্টোবর এ মাঠে গণসমাবেশ করে।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী এই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঞ্চালনায় জনসভার কার্যক্রম শুরু হয়। এতে বক্তৃতা দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিম-লীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ড. আব্দুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, ড. হাছান মাহমুদ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, পানি সম্পদ উপ-মন্ত্রী এনামুল হক শামীম, শিক্ষা উপ-মন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ সালাম, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ এমপি, এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী এমপি, ড. আবু রেজা, মো. নদভী এমপি, দিদারুল আলম এমপি, নজরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি, এমএ লতিফ এমপি, নিজাম উদ্দিন হাজারী এমপি, আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক ওয়াসিকা আয়েশা খান এমপি, খাদিজাতুল আনোয়ার সনি এমপি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইসাহক আলী খান পান্না, যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল প্রমুখ। আ জ ম নাছির উদ্দীনের সঙ্গে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন। পলোগ্রাউন্ড মাঠের এই জনসভায় ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি হত্যাকা-ের ভয়াল ঘটনা স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, লালদীঘি ময়দানে গুলি করে ৩০ জনকে হত্যা করে পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা। খালেদা জিয়া তাকে প্রমোশন দিয়ে পুলিশের প্রধান করেছিলেন। শেখ হাসিনা প্রশ্ন করে বলেন, যদি লালদীঘি হত্যাকা-ে খালেদা জিয়া জড়িত নাই থাকেন তবে কেনো হামলাকারী পুলিশকে তিনি (খালেদা জিয়া) প্রমোশন দিয়েছিলেন। এ হামলায় ভাগ্যক্রমে নিজে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন বলে জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বিএনপির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ওরা (বিএনপি) জানে ইলেকশন হলে জনগণ তাদের ভোট দেবে না। তাই তারা ইলেকশন চায় না, সরকার উৎখাত করে এমন কিছু আসুক যারা একেবারে নাগরদোলায় করে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে এটাই তারা আশা করে। তারা জনগণের তোয়াক্কা করে না। ওরা ভোটে যেতে চায় না। জিয়াউর রহমান যেমন জাতির পিতাকে হত্যা করে, সংবিধান লঙ্ঘন করে, সেনা আইন লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করেছিল। ওদের ধারণা ওই ভাবেই তারা ক্ষমতায় যাবে। গণতান্ত্রিক ধারা তারা পছন্দ করে না। জনমত সৃষ্টি করতে পারবে না বলেই গুজব রটাচ্ছে বিএনপি। মানুষকে বিভ্রান্ত করাই তাদের (বিএনপি-জামায়াত) কাজ। তাই নির্বাচন নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
বিএনপির আন্দোলনের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, তাদের আন্দোলন হচ্ছে মানুষ খুন করা। বিএনপির দুইটা গুণ আছে, ভোট চুরি আর মানুষ খুন; ওইটা পারে। ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপির আন্দোলনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষ হত্যা, মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করার জবাব একদিন খালেদা জিয়া-তারেক জিয়াকে দিতে হবে, এর হিসাব একদিন জনগণ নেবে।
রিজার্ভ এবং ব্যাংকে টাকা নেই এমন গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি আমি, আর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে অপপ্রচার করা হচ্ছে। অথচ এই কয়েক দিনে যারা টাকা তুলতে গেছে তারা সবাই তো টাকা তুলতে পেরেছে। মানুষকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, টাকা তুলে ঘরে আনলে, চোরেও নিতে পারে। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে চোরের সখ্য আছে কি না এমন মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, এই যে মানুষের সর্বনাশ করা এটাই বিএনপি-জামায়াত শিবিরের কাজ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ নিয়ে কিছু দিন কষ্ট হয়েছিল। ভবিষ্যতে আর হবে না ইনশাআল্লাহ। তবে আপনাদের কাছে অনুরোধ, সাশ্রয়ী হতে হবে। বিদ্যুৎ ব্যবহার সীমিত করতে হবে। আপনারা জানেন না, এই শীতকালে ইউরোপের ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের কী অবস্থা। তারা গরম পানি পাচ্ছে না। তারা রুম হিট করতে পারছে না। এক রুমের মধ্যে সব পরিবার নিয়ে থাকতে হচ্ছে। দোকানে গেলে জিনিস কিনতে পারে না। হয়তো এক প্যাকেট জিনিসের বেশি একটি পরিবার কিনতে পারবে না। এমন অবস্থা তাদের। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশে এই অবস্থা হবে না। আমরা মানুষের সবরকম সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখব। কিন্তু আপনাদের (দেশবাসী) সহযোগিতা চাই।
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখনও পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে মজবুত। বিশ্বব্যাপী এখন খাদ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের অভাব। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি আমাদের দেশের মানুষ যাতে ভালো থাকে। ‘নিঃস্ব আমি, রিক্ত আমি, দেবার কিছু নাই; আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।’ কবিতার অনুকরণে আবৃত্তি করে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে ৫০ মিনিটের বক্তব্য শেষ করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।