স্টাফ রিপোর্টার: গত কয়েক মাস ধরেই হু হু করে বেড়েই চলেছে দেশের মূল্যস্ফীতির হার। গত এপ্রিলে বেড়ে দাঁড়ায় ৬.২৯ শতাংশে। মে মাসে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। জুন মাসে সেটি বেড়ে দেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৭.৫৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন তারা। অবশ্য পরিসংখান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির যে হিসাব প্রকাশ করেছে, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি তার চেয়ে বেশি বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা।
যেভাবে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি: কয়েক মাস ধরে বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি’র তথ্য অনুযাীয় সাম্প্রতিকালে দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের মধ্যে প্রায় ৩১টি পণ্যের দাম বাড়তি আছে। এ ছাড়া গত নভেম্বর মাসে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পরের মাস ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ অতিক্রম করে। অবশ্য জানুয়ারি মাসে তা আবার ৬ শতাংশের ঘরে চলে আসে। এরপর ফেব্রুয়ারি মাস শেষে সপ্তাহে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে মূল্যস্ফীতি ফের বেড়ে ৬ শতাংশে উঠে যায়।
অন্যদিকে গত তিন মাস ধরে চলমান ডলার সংকট দেখা দেয়। দেশের আমদানি ব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। এতে আমদানিকারকদের পণ্য আমদানি খরচ বেড়ে যায়। ফলে গত মে ও জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ময়নুল ইসলাম বলেন, গত বছর যে ইনকাম দিয়ে সংসারের খরচ চালিয়েছেন, এই বছর আর সেই টাকায় চালাতে পারছেন না। মাস শেষ হওয়ার আগেই টাকা নাই হয়ে যাচ্ছে। আয় কিন্তু ওই একই আছে। তিনি বলেন, গত বছর এই সময় চাল কিনেছেন ৫৬ টাকা কেজি দরে, একই চালের জন্য এখন দিতে হচ্ছে ৭২ টাকা। বাড়ি ভাড়া বেড়েছে, যাতায়াতের খরচ বেড়েছে। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এর আগে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ৭.৮৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। অর্থাৎ গত ৯ বছরে এই জুন মাসের মতো এত মূল্যস্ফীতি আর হয়নি। মহামারির ধাক্কা সামলে অর্থনীতির গতি বাড়ায় গতবছরের শেষদিক থেকেই মূল্যস্ফীতি ছিল বাড়তির দিকে। চলতি বছরের শুরুতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে জ্বালানি ও খাদ্যমূল্য বাড়তে শুরু করে। তার প্রভাব পড়ে অন্যান্য পণ্যেও। এভাবে ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির হার বাড়ায় দুর্ভোগে পড়েছে সীমিত আয়ের মানুষ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্যমতে, মূলত পাঁচ মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। গত জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নিচে ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে তা ৬ শতাংশ অতিক্রম করে। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে মূল্যস্ফীতির হার। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ৭.৫৬ শতাংশ নয়, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আসলে আরও বেশি। বিশেষ করে গরিব মানুষের ওপর এই মূল্যস্ফীতির চাপ ১০ শতাংশের বেশি।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির কারণে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে। তবে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার কম। তিনি বলেন, বর্ষাকালে বিশেষ করে জুলাই থেকে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি একটু বাড়ে। মূল্যস্ফীতির চক্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ সময় সাধারণত খাদ্যমূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পায়। কারণ, এ সময়ে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
এদিকে বাজারে মোটা চালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ৮ টাকা বেড়ে এখন ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্য তেলের দাম লিটার প্রতি দাম ২০০ টাকা ঠেকেছে। আর ডালের দাম গড়ে ১০ টাকা বেড়েছে। চিনির দামও কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই রয়েছে মূল্যবৃদ্ধির চাপ।
গত জুন মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত-দুই ধরনের পণ্যেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বিবিএস’র তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে দেশে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৩৭ শতাংশ। গত মে মাসে এই হার ছিল ৮.৩০ শতাংশ। আর জুন মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬.৩৩ শতাংশ। গত মে মাসে এই হার ছিল ৬.০৮ শতাংশ।
অর্থাৎ চাল-ডাল, তেল, মাছ-মাংসসহ খাদ্যপণ্য কিনতে মানুষকে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। আবার শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষকে বেশি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। কারণ, বিবিএস’র তথ্য বলছে, শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেশি। বিবিএস’র হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.০৯ শতাংশ। একই সময়ে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.৬২ শতাংশ। বিবিএস’র তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছে ৮.৯৩ শতাংশে। শহরাঞ্চলে এই হার ৭.১১ শতাংশ।
বিবিএস’র মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় মজুরি সূচক বিশ্লেষণ করলে দেখা গেছে, সাধারণত মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি থাকে। কয়েক মাস ধরেই এর ব্যতিক্রম। বিবিএস বলছে, ২০১০-১১ ভিত্তিবছর ধরে গত জুন মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ৬.৩৮ শতাংশ, যা সার্বিক মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। অর্থাৎ যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সেই হারে মজুরি বাড়ছে না। ফলে মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মীর্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, মূল্যস্ফীতি বাড়লে দরিদ্র মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের ওপর চাপ বেশি পড়ে। খাদ্যপণ্য কিনতেই তাদের আয়ের সিংহভাগ খরচ হয়। বর্তমানে চাল-ডাল, তেল-সবকিছুর দাম বাড়ছে। তাই মূল্যস্ফীতি বাড়লে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগী বাড়াতে হবে। তাদের সুষ্ঠুভাবে খাদ্যপণ্য বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০০৫-০৬ এর খানা জরিপে আয়-ব্যয়ের তথ্যের ভিত্তিতে কনজ্যুমার প্রাইস ইনডেক্স তৈরি করে। ফলে মূল্যস্ফীতির তথ্যে বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হয়েছে।
উল্লেখ্য, ৬ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে গত অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৫.৪ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) গড়ে ৬.১৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরে রাখা যায়নি। নতুন ২০২২-২৩ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে রাখবেন বলে বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন।