স্টাফ রিপোর্টার: দেশে করোনাভাইরাস ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। কঠোর বিধিনিষেধের সময়ও বেড়ে চলেছে সংক্রমণ ও মৃত্যু। প্রতিদিনেই হচ্ছে নতুন রেকর্ড। হাজার হাজার পরিবার করোনার ছোবলে বিধ্বস্ত। গত এক সপ্তাহে দেশে করোনা কেড়ে নিয়েছে এক হাজার ২৭৭ প্রাণ। আগের সপ্তাহে মারা গেছেন ৮৫৯ জন। এক সপ্তাহে মৃত্যু বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এ সময়ে ১২ দশমিক ৩৯ শতাংশ নমুনা পরীক্ষা বাড়লেও শনাক্ত বেড়েছে ৩৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গত এক সপ্তাহে সুস্থতার হার বেড়েছে ৩৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ। শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এদিকে করোনার উপসর্গ নিয়েও মৃত্যু বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের তথ্যমতে, ৬ জুলাই পর্যন্ত শুধু উপসর্গ নিয়ে সারা দেশে মারা গেছেন ২৯৩৯ জন। ২২ জুনের আগের দুসপ্তাহে (৯-২২ জুন) সারা দেশে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান ১৫১ জন। সর্বশেষ দুসপ্তাহে (২৩ জুন-৬ জুলাই) এ সংখ্যা ৪৮৬।
বিশেষজ্ঞদের মতে নমুনা পরীক্ষা না হওয়ায় উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু বাড়ছে। বিশেষ করে গ্রামে করোনার নমুনা পরীক্ষা সংখ্যা খুবই কম। তারা আক্রান্ত হচ্ছেন কিন্তু পরীক্ষা করাচ্ছেন না। শেষ সময়ে আসছেন হাসপাতালে। তখন অবস্থা খুবই খারাপ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের রোগী বাঁচানো যাচ্ছে না। উলটো মৃত্যুর আগে তারা বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা করেছেন। বিশেষ করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন। হাট-বাজারে গেছেন, চা-দোকানে বসে আড্ডা দিয়েছেন। এর প্রতিটি স্থানে ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটিয়েছেন। ফলে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাদের মতে, নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়বে। সেক্ষেত্রে শানাক্ত রোগীদের আলাদা করে চিকিৎসা দিতে পারলে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের বিস্তার কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব। তাদের মতে, নমুনা পরীক্ষা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই, এটা বাড়াতেই হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ও সংক্রমণ কমেছে। তবে বেড়েছে শনাক্তের হার। শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় নমুনা পরীক্ষা আগের দিনের চেয়ে অনেক কম হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ২৭ হাজার ৮৮৪টি। আগের দিন এ সংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার ৫৮৬। অর্থাৎ আগের দিনের চেয়ে ৮৭০২টি নমুনা পরীক্ষা কম হয়েছে। দেশে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে একদিনে আরও ১৮৫ জন মারা গেছেন। আগের দিন সর্বাধিক ২১২ জনের মৃত্যু হয়। সবমিলিয়ে করোনায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১৬১৮৯। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৮৭৭২ জনের দেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আগের দিন এ সংখ্যা ছিল ১১৩২৪। এ নিয়ে দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা হয়েছে ১০ লাখ ৯ হাজার ৩১৫। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আগের দিন এ হার ছিল ৩০ দশমিক ৯৫ শতাংশ। সরকারি হিসাবে ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৫৭৫৫ জন। এ পর্যন্ত সুস্থ হলেন ৮ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৯ জন।
সীমান্তবর্তী এলাকায় পাশাপাশি রাজধানী ও আশপাশের জেলাগুলোতে সংক্রমণ ও মৃত্যু উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে সর্বাধিক ৭১ জন মারা গেছেন। একই সময়ে দেশের অর্ধেকের বেশি ৪৪৯২ নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন এ বিভাগে। শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আবার এ বিভাগের মধ্যে শুধু ঢাকা জেলায় (মহানগরসহ) শনাক্ত হয়েছেন ৩৩৯৬ জন। শনাক্তের হার ২৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলায়ও বাড়ছে করোনা। পাহাড়ি এলাকাতেও ভয়াবহ ছোবল বসাচ্ছে এ মহামারী। খাগড়াছড়িতে ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ৭৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। খুলনা বিভাগেও করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ। ২৪ ঘণ্টায় এ বিভাগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫১ জন মারা গেছেন। খুলনা জেলায় শনাক্তের হার ৪৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। বরিশাল বিভাগেও সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় এ জেলায় শনাক্তের হার ৫০ শতাংশের উপরে।
এ পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর চাপ। আইসিইউ নয়, সাধারণ শয্যা পাওয়া এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করোনা আক্রান্ত জটিল রোগী প্রতিদিনই আসছেন রাজধানীর হাসপাতালে। তাদের অনেকের আইসিইউ প্রয়োজন। স্বজনরা নানা উপায়ে দেনদরবার করেও তা পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে ছুটছেন অন্য হাসপাতালে। শুধু ঢাকা নয়, সীমান্তবর্তী জেলা-উপজেলার হাসপাতালের চিত্র আরও ভয়াবহ। খালি নেই শয্যা। মেঝেতে রেখেই চলছে চিকিৎসা। অনেক হাসপাতালে দেখা দিয়েছে অক্সিজেন সংকটও।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৬১৩টি ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব ১৩০টি, জিন এক্সপার্ট ৪৮টি, র্যাপিড অ্যান্টিজেন ৪৩৫টি। দেশে এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৬৯ লাখ ৩১ হাজার ১৫২ টি। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৬ দশমিক শূন্য এক এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬০ শতাংশ। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১২১ ও নারী ৬৪ জন। সরকারি হাসপাতালে ১৪৪ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ২৮ জন ও বাড়িতে ১২ জন মারা গেছেন। হাসপাতালে মৃতাবস্থায় আনা হয় একজনকে। মৃতদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ২০ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৩ জন, বরিশাল বিভাগে ১০ জন, সিলেট বিভাগে সাতজন, রংপুর বিভাগে ১১ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে তিনজন রয়েছেন। তাদের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬০ বছরে ঊর্ধ্বে ৯২ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৫১ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ২২ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ১৩ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে পাঁচজন এবং ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে একজন ও ১০ বছরের নিচে একজন আছেন।