স্টাফ রিপোর্টার: দেশে করোনায় একদিনে ২৬৪ জন মৃত্যুর নতুন রেকর্ড হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এদের মৃত্যু হয়। একই সময়ে ১২ হাজার ৭৪৪ জন প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে নতুন করে আক্রান্ত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন, দেশে করোনাক্রান্তের ৯৮ শতাংশই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের শিকার। বাকি দুই শতাংশ বেটা ও মরিশাস ভ্যারিয়েন্ট। গত জুলাই মাসে ৩ লাখ ২৯ হাজারের বেশি মানুষ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে করোনাক্রান্ত হয়েছে। শিশুরাও এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকিতে আছে। দেশব্যাপী করোনা পরিস্থিতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কঠোর বিধিনিষেধের পরও থামছে না এর ভয়াবহতা। লম্বা হচ্ছে লাশের মিছিল। সংক্রমণও লাগামহীন। টানা ১২ দিন ধরে দৈনিক মৃত্যু ২০০ ওপরে। ২৪ ঘণ্টায় ২৬৪ জনের প্রাণ কেড়ে নেয় করোনা। এর আগে ২৭ জুলাই সর্বোচ্চ ২৫৮ জন মারা যায়। সবমিলিয়ে দেশে করোনায় মারা গেছে ২১ হাজার ৯০২ জন। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহেই মারা গেছে ১৬৪৭ জন। করোনা শনাক্তের পর এক সপ্তাহে এত লোকের প্রাণহানি হয়নি। সাত দিনে মৃতদের মধ্যে পুরুষ ৯৩৪ ও নারী ৭১৩ জন। এক সপ্তাহে রেকর্ড নমুনা পরীক্ষায় ৯৬ হাজার ৪০১ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এ সময়ে সুস্থ হয়েছেন এক লাখ ৬ হাজার ৭২৩ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো তথ্য পর্যালোচনা করে এসব জানা গেছে।
এদিকে করোনাভাইরাসে শনাক্তের ৯৮ ভাগই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। জুলাই মাসে কোভিডে আক্রান্ত ৩০০ জনের নমুনা থেকে পাওয়া ভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ করে ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গবেষকরা। বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) জেনোম সিকোয়েন্সিং রিসার্চ প্রজেক্টের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্যটি প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ৩০০ নমুনার জিনম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছেন, মোট সংক্রমণের প্রায় ৯৮ শতাংশ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, যা ভারতে প্রথম শনাক্ত হয়েছিল। এছাড়া ১ শতাংশ সংক্রমণ হয়েছে সাউথ আফ্রিকায় প্রথম পাওয়া বেটা ভ্যারিয়েন্টের কারণে। যদিও আমাদের গবেষণায় প্রথম ১৫ দিনে এই সংখ্যা ছিলো ৩ শতাংশ। একজন রোগীর ক্ষেত্রে আমরা পেয়েছি, মরিশাস ভ্যারিয়েন্ট অথবা নাইজেরিয়ান ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। শিশুদের মধ্যেও কোভিড সংক্রমণ ঝুঁকি নেই সেটা বলা যাচ্ছে না। জুলাই মাসে দেশে মোট শনাক্ত হয়েছে ৩ লাখ ৩৬ হাজার ২২৬ জন। বিএসএমএমইউর গবেষণার ভিত্তিতে বলা যায়, গত মাসের মোট শনাক্তের ৩ লাখ ২৯ হাজার ৪৭৬ জনই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। যা শতকরার হিসাবে ৯৮ শতাংশ। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় দেশে মৃত্যুতে রেকর্ড হলেও সংক্রমণ ও শনাক্তের হার কিছুটা কমেছে। একদিনে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ১২ হাজার ৭৪৪ জন। বুধবার শনাক্ত হয়েছিলো ১৩ হাজার ৮১৭ জন। এ নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২২ হাজার ৬৫৪ জনে। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২৭ দশমিক ১২ শতাংশ। আগের দিন এ হার ছিল ২৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। সরকারি হিসাবে একদিনে সেরে উঠেছেন ১৫ হাজার ৭৮৬ জন। তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত সুস্থ হলেন ১১ লাখ ৫৬ হাজার ৯৪৩ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ মৃত্যুর পাশাপাশি নমুনা পরীক্ষা এবং শনাক্তও হয়েছে সর্বাধিক। এ সময় ৩ লাখ ৩০ হাজার ৮০৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে শনাক্ত হয়েছে প্রায় এক লাখ। এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ মৃত্যু এবং শনাক্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এ সময়ে ঢাকা বিভাগে মোট মৃত্যু হয়েছে ৫৩৬ জন এবং ৪৪ হাজার ১০৩ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। শনাক্ত ও সংক্রমণের দিক থেকে ঢাকার পরেই চট্টগ্রাম বিভাগ। এ বিভাগে এক সপ্তাহে মারা গেছে ৪১৪ এবং শনাক্ত হয়েছে ২৩ হাজার ২০০ জন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৭০৭টি ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব ১৩৩টি, জিন এক্সপার্ট ৫৩টি, র্যা পিড অ্যান্টিজেন ৫২১টি। এসব ল্যাবে ৪৬ হাজার ৫২২টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করা হয়েছে ৪৬ হাজার ৯৯৫টি। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৭৯ লাখ ৯৫ হাজার ৬৭৮টি। এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৭ দশমিক ৪৭ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে পুরুষ ১৪০ ও নারী ১২৪ জন। এদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ১৯০, বেসরকারি হাসপাতালে ৫৫ ও বাড়িতে ১৯ জন মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ৮৭ জন। চট্টগ্রাম বিভাগ ৫৬, রাজশাহী বিভাগে ১৯, খুলনা বিভাগে ৩৫, বরিশাল বিভাগে ১৬ জন, সিলেট বিভাগে ২৩, রংপুর বিভাগে ১৮ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জন আছেন। তাদের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৯১ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে তিনজন, ৮১ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে ১৫ জন, ৭১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে ৫০ জন, ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে ৭৪ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৫৯ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ৩১ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ২৫ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে পাঁচজন, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে একজন এবং ১০ বছরের নিচে একজন রয়েছেন।
বিএসএমএমইউর গবেষণার ফল : বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) জেনোম সিকোয়েন্সিং রিসার্চ প্রজেক্টের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে ৩০০ নমুনার জিন সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এদের মধ্যে প্রায় ৯৮ শতাংশ ডেল্টা ভ্যারিয়েণ্টে আক্রান্ত। চলতি বছরের ২৯ জুন থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত দেশব্যাপী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ওপর এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এ গবেষণায় নেতৃত্ব দেন বিএসএমএমইউর জেনেটিক্স অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. লায়লা আনজুমান বানু। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলোজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাইদুর রহমান। অনুষ্ঠানে উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদ হোসেন, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
গবেষকরা জানান, তথ্য বিশ্লেষণের জন্য দেশের সবগুলো বিভাগের রিপ্রেজেন্টেটিভ স্যাম্পলিং করেন তারা। মোট ৩০০ কোভিড পজিটিভ রোগীর ন্যাজোফ্যারিনজিয়াল সোয়াব স্যাম্পল থেকে নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়। এ সময় বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন বলেন, এই গবেষণার মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অতিসংক্রমণজনিত ভাইরাস। বাঁচতে হলে গণটিকাদান কার্যক্রম ও গণমাস্ক ব্যবহারের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত আক্রান্তদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ পুরুষ, যাদের বয়স ৯ মাস থেকে ৯০ বছরের মধ্যে ছিলো। এর মধ্যে ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সী রোগীর সংখ্যা ছিলো বেশি। যেহেতু কোনো বয়সসীমাই কোভিড-১৯ এর জন্য ইমিউন করছে না, সে হিসাবে শিশুদের মধ্যেও কোভিড সংক্রমণের ‘ঝুঁকি নেই’- এমনটা বলা যাচ্ছে না। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যাদের শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসারের মতো ‘কো-মরবিডিটি’ রয়েছে, তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেশি বলে গবেষণায় দেখা গেছে। পাশাপাশি ষাটোর্ধ্ব বয়সি রোগীদের দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হলে সে ক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকছে। এ গবেষণায় টিকার কার্যকারিতার বিষয়টিও দেখা হচ্ছে, সে কাজ চলমান রয়েছে।
গবেষণার তথ্য থেকে তুলে ধরে শারফুদ্দিন আহমেদ জানান, বাংলাদেশে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে আলফা ভ্যারিয়েন্টের (যুক্তরাজ্যে উদ্ভূত) সংক্রমণ হার বেশি ছিল। পরে ২০২১ সালের মার্চের তথ্যে সাউথ আফ্রিকায় প্রথম পাওয়া বেটা ভ্যারিয়েন্টের দাপট দেখা যায়। অনুষ্ঠানে গবেষণার প্রথম মাসের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। পরের মাসগুলোতেও হালনাগাদ ফলাফল প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয়। মোট ৩ হাজার রোগীর স্যাম্পল সিকোয়েন্সিং বিশ্লেষণ করে বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক তৈরি করা সম্ভব হবে।