স্টাফ রিপোর্টার: গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অস্থির মুরগি ও ডিমের বাজার। শুরুতে বাজার সিন্ডিকেট ও পরে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে পোলট্রি ফিডের দাম বৃদ্ধিকে কারণ হিসেবে দায়ী করা হলেও এর নেপথ্যে রয়েছে একচেটিয়া কর্পোরেট উদ্যোক্তাদের পুঁজির আধিপত্য। এ ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ, অপ্রতিষ্ঠিত সাপ্লাাই চেইন, প্রান্তিক খামারিদের পুঁজির সংকট ও ব্যবসা সংকোচনসহ এ খাতে নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ না করাকে দুষছেন বিশ্লেষকরা। পোলট্রি খাতকে বলা হয়, ফিড কনর্ভাট টু ফুড, যা সম্পূর্ণ হয় মোট ১০ ধাপে। মোটা দাগে ৩ ধাপে অর্থাৎ ১ দিনের বাচ্চা উৎপাদানকারী প্রতিষ্ঠান বা খামার, মুরগি বা ডিম উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িতদের মাধ্যমে সম্পূর্ণ হয় গোটা প্রক্রিয়া। ফলে এর যে কোনো একটি চেইনে সংকট দেখা দিলে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বৃদ্ধি পায়। দেখা গেছে, গোটা প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ও জটিল ধাপ ১ দিনের বাচ্চা শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। বাকি ধাপগুলো পরিচালিত হয় প্রায় দেড় লাখ প্রান্তিক খামারি ও বাজারজাকারীদের মাধ্যমে। তবে ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই বাজারে সব মুরগির দাম চড়া। এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১ দিনের বাচ্চা উৎপাদনকারীরা বাচ্চার দাম প্রায় ৮ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে বাজার অস্থিশীল রয়েছে। এসব বাচ্চার ক্রেতা ডিম ও মুরগি উৎপাদনকারী প্রান্তিক খামারিরা জানান, মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে ৯ টাকা মূল্যের ১ দিনের বাচ্চা গত দু-সপ্তাহ ধরে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। ফলে তাদের উৎপাদন খরচ প্রতিকেজি ব্রয়লারে ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা দাঁড়িয়েছে। তাদের অভিযোগ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে গোটা পোলট্রি খাত জিম্মি। মুরগির ফিড, ভ্যাকসিন, ওষুধ ও ভিটামিনের বাজারও তাদের হাতে। ফলে মুরগির দামের ওঠানামা নির্ভর করে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মর্জির ওপর। এদিকে, ডলার সংকটসহ বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের বাজারে আমদানিসহ প্রায় সব পণ্যের দামই আকাশছোঁয়া। চাহিদা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের আমদানি নেমেছে অর্ধেকে, সমহারে বেড়েছে দামও। যার প্রভাবে দেশে উৎপাদিত পোল্ট্রি পণ্য মুরগির ও ডিমের দাম কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বিশেষ করে মুরগির মাংশের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অস্বাভাবিক ডিমের বাজারও। ফেব্রুয়ারির শুরুতে প্রতিকেজি ব্রয়লার ১৪০ টাকা এবং সোনালি মুরগি বিক্রি হয়েছে ২১০ টাকা কেজি। যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২৬০ এবং ৩৪০ টাকা কেজি দরে। এ সময় ৩৮ টাকা হালির ডিম হয়েছে ৫০ টাকা। দেখা গেছে, গত বছরের এই সময়ে তুলনায় ব্রয়লারে দেড়শ এবং ডিমের প্রায় ৩০ শতাংশ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়েছে যে, বাজার নিয়ন্ত্রণে মুরগি ও ডিমকে অত্যবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, শিগগিরই আইন সংশোধন করে অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় মুরগি ও ডিম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৫৬ অনুযায়ী এর আওতাধীন বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন, বিপণন এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পাবে সরকার। ফলে দাম নিয়ন্ত্রণসহ বাজার কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। দেখা গেছে, গ্রীষ্মে গরমের, শীতে ঠান্ডার আর বর্ষায় ভাইরাস ও সরবরাহ সংকটের অজুহাতে একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করছে অসাধু একটি চক্র। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দেশের পোলট্রি খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পোল্ট্রি নীতিমালা অনুযায়ী আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু তা না হওয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ভোক্তার অর্থ হাতিয়ে নেওয়া চলতেই থাকবে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার জানান, গত ১ মাসে নতুন করে এমন কোনো সংকট তৈরি হয়নি যে, ১ দিনের বাচ্চা মুরগির দাম ৯ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা হতে পারে। এ ছাড়া মুরগি ও ডিম উৎপাদন খাতের বাজারের ১০ থেকে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। এর মধ্যে নিজস্ব উৎপাদনের চেয়ে চুক্তি-ভিত্তিক খামারই বেশি। ফলে বাজারে মুরগি ও ডিমের দাম ঠিক হয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। মূলত কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব মুরগির বাচ্চা উৎপাদন ব্যবস্থা, নিজস্ব ফিড মিল, মেডিসিনসহ উন্নত মেশিনারিজ ব্যবহারের ফলে প্রান্তিক খামারিরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। বিশেষ করে খামারিদের লোকসান ও পুঁজির সুযোগ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। সুমন হওলাদার বলেন, আগে এসব প্রতিষ্ঠান শুধু বাচ্চা উৎপাদন করত, এখন তারা লোকসানে থাকা খামারিদের মাধ্যমে ডিম ও মুরগি উৎপাদন খাতেও তাদের আধিপত্য বাড়াচ্ছে। যেমন ব্রয়লার মুরগির এক বস্তা ফিড প্রান্তিক খামারি কিনছেন ৩ হাজার ৫০০ টাকায়, এটাই আবার কোম্পানির চুক্তি-ভিত্তিক খামারিরা কিনছেন ২ হাজার ৫০০ টাকায়। এই ব্যবধানের ফলে চুক্তি ভিত্তিক খামারি ১৪০ টাকা দরে প্রতিকেজি মুরগি বিক্রি করে লাভ করলেও একই দামে মুরগি বিক্রি করে প্রায় ৪০ টাকা লোকসান গুণছেন প্রান্তিক খামারিরা। ফলে অনেকই ব্যবসা ছেড়ে চুক্তিতে মুরগি উৎপাদন করছেন। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দাবি, গত এক বছর ধরেই খামারিরা দেড়শ টাকার মতো উৎপাদন খরচ দিয়ে মুরগি উৎপাদন করে বিক্রি করেছেন সর্বোচ্চ ১২০ টাকায়। এ কারণে এক বছরে উৎপাদনকারী খামারির সংখ্যা এক লাখ ৬০ হাজার থেকে কমতে কমতে এখন ৬০ হাজারে এসে ঠেকেছে। এখন এসব খামারিদের আবার চুক্তিতে মুরগি ও ডিম উৎপাদনে কাজে লাগাচ্ছেন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, প্রান্তিক খামারি ও কর্পোরেট উভয়ের উৎপাদন খরচ একই থাকলে ইচ্ছাকৃতভাবে মুরগির দাম কমিয়ে দেয়া হয় চুক্তিতে থাকা খামারিদের মাধ্যমে। সাভারের মিজান পোল্ট্রি ফার্মের পরিচালক আহসান হাবিব জানান, আগে তারা বাচ্চাসহ মুরগি ও ডিম উৎপাদন করলেও এখন কেবল মুরগি উপাদন করেন। তিনি বলেন, আমাদের একটা বাচ্চা উৎপাদনে যে খরচ পড়ে তার অর্ধেক দামেই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ১ দিনের বাচ্চা বিক্রি করে। দিনে তারা সর্বোচ্চ ২ হাজার বাচ্চা উৎপাদন করে অন্যদিকে একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান দিনে ২০ লাখ পর্যন্ত বাচ্চা উৎপাদন করে। তাই লোকসানের কারণে এই এলাকার সব পোল্ট্রি উদ্যোক্তারা বাচ্চা উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন ডিম ও মুরগিও বিক্রি করতে হচ্ছে প্রতি কেজিতে ২০-২৫ টাকা লোকসানে। কারণ চুক্তিতে থাকা খামারিরা কম দামে বাজারে মুরগি ছেড়ে দিচ্ছেন। সুমন হওলাদার বলেন, যখনই প্রান্তিক খামারিরা উৎপাদন বাড়ান ঠিক তখনই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিয়ন্ত্রিত খামারিদের দিয়ে বাজারে মুরগির দাম কমিয়ে দেন। ফলে বড় অংকের লোকসানে পড়ে সাধারণ খামারিরা। আর এই সুযোগটাই গ্রহণ করে লোকসানে থাকা খামারিদের দিয়ে চুক্তিতে ব্যবসা করেন তারা। এ ক্ষেত্রে লাভ-লোকসান কোনোটাই খামারির হাতে থাকে না। এভাবেই খামারিদের পুঁজি আর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে বাচ্চা উৎপাদনের পাশাপাশি ডিম ও মুরগি উপাদনেও তাদের আধিপত্য বাড়াচ্ছে। তাই এই সংকট সমাধানে সরকারের পোল্ট্রি নীতিমালা সংশোধনসহ প্রান্তিক খামারিদের রক্ষায় সহায়ক নীতি ঘোষণার দাবি জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে পুঁজি সহায়তা, মেডিসিন ও ফিড আমদানি সহজ করে প্রান্তিক খামারিদের স্বনির্ভর করার দাবিও করেন তারা।