কৃষি উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকি
স্টাফ রিপোর্টার: করোনা এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যদিয়ে এগোচ্ছে। আগামী বছর বিশ্বব্যাপী এ মন্দা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। মন্দার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকা- হ্রাস পাবে, বিনিয়োগ কমে যাবে। এর প্রভাবে কর্মসংস্থানের গতিও কমবে, বাড়বে বেকারত্ব। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। বিশ্ব বাণিজ্য হ্রাস পাবে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মানে অস্থিরতা অব্যাহত থাকবে। জ্বালানি সংকটের কারণে কৃষি উপকরণের দাম বাড়বে। এতে কৃষি উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকি হবে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বাড়বে। সব মিলে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় সার্বিকভাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাডের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। শুক্রবার আঙ্কটাডের ওয়েবসাইটে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে।
এর আগে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে এ ধরনের আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছে। এবার আঙ্কটাডের প্রতিবেদনেও একই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় জ্বালানির ব্যবহার কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এ খাতে সরকারি নির্দেশনা জারি করে জ্বালানি সাশ্রয়ে ভোক্তাদের বাধ্য করেছে। এর মধ্যে শ্রীলংকা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। কেননা শ্রীলংকায় সংকট প্রকট। বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতির হার রোধে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুস্মরণ করছে। বিনিময় হার ধরে রাখতে আমদানি কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মাধ্যমে বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে পণ্যের সরবরাহ ও উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণ কমলে হঠাৎ বিশ্বব্যাপী পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে পণ্যের সংকটের কারণে দাম বেড়ে যায়। ফলে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এরপর এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। এতে বিশ্বব্যাপী পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে পণ্যের দামও বেড়ে যায় হুহু করে। ফলে করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার বাধাগ্রস্ত হয়। বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ইউরোপ-আমেরিকাসহ প্রায় সব দেশে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড হারে বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এতে অর্থের প্রবাহ কমে গিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকা- সংকুচিত হয়ে পড়ে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এছাড়া আমেরিকা সুদের হার বাড়িয়ে ডলারের দাম বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে। এছাড়া ইউরোপ ও উন্নত দেশগুলো মুদ্রার মান ধরে রাখতে সুদের হার বাড়িয়েছে। এসব মিলে বড় অর্থনীতির দেশগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। ওইসব দেশের অর্থনীতির ওপর ছোট অর্থনীতির দেশগুলো নির্ভরশীল। তাদের মন্দায় প্রভাব ছোট অর্থনীতির দেশগুলোয় পড়েছে। আগামী অর্থবছরে মন্দার এ প্রকোপ আরও প্রকট আকার ধারণ করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্নত দেশগুলো চলতি বছর থেকেই মুদ্রার প্রবাহ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। আগামী বছর এর প্রভাব আরও প্রকট হবে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা আরও বাধাগ্রস্ত হলে মন্দা আরও প্রকট হবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে দুই দেশের যুদ্ধপরিস্থিতির ওপর।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চলতি বছর প্রাক্কলন করা হয়েছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ। গত মার্চ পর্যন্ত আশা করা হয়েছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি বাড়বে না। বরং শূন্য দশমিক ১ শতাংশ কমে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। আগামী বছর তা আরও কমে ২ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। উন্নত দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমে যাবে। এর প্রভাবে ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধিও কমবে। তবে আগামী বছর চীনসহ কয়েকটি দেশের প্রবৃদ্ধির হার সামান্য বাড়বে। তবে তা গত বছরের চেয়ে কম, চলতি বছরের চেয়ে সামান্য বেশি।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি ২০২১ সালে হয়েছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ, চলতি বছর তা কমে হতে পারে ১ দশমিক ৯ শতাংশ। আগামী বছর তা আরও কমে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। অপর বড় অর্থনীতির দেশ কানাডায় গত বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, এ বছর তা কমে ৩ দশমিক ২ শতাংশে নামতে পারে। আগামী বছর তা আরও কমে ২ দশমিক শতাংশ হতে পারে। চীনের প্রবৃদ্ধি গত বছর হয়েছিল ৮ দশমিক ১ শতাংশ, এ বছর তা কমে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। আগামী বছর তা সামান্য বেড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রবৃদ্ধি গত বছর হয়েছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এ বছর তা কমে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হতে পারে। আগামী বছর তা আরও কমে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ হতে পারে। যুক্তরাজ্যের প্রবৃদ্ধি গত বছর হয়েছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এ বছর তা আরও কমে হতে পারে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। আগামী বছর তাদের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে বলে প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের প্রবৃদ্ধি গত বছর হয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এ বছর তা কমে ২ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। আগামী বছর এদের প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ১ শতাংশে নেমে যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বর্তমানে শ্রীলংকা, পাকিস্তানের অবস্থা খুব খারাপ। আফগানিস্তানের অবস্থাও ভালো নয়। নেপালেও সংকট বেড়েই চলেছে। তবে ভুটান বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে।
বিশ্বের অন্য দেশগুলোর প্রবৃদ্ধিও কমে যাবে। অঞ্চলভেদে সব এলাকায় এ হার কমবে। প্রবৃদ্ধি কমার পাশাপাশি মূূূল্যস্ফীতির হারও বাড়তে পারে। সরকারি হিসাবে গত বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ বছর প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। তবে এ তথ্য আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক মানতে নারাজ। তাদের মতে, প্রবৃদ্ধি আরও কম হয়েছে। আগামী বছর আইএমএফের মতে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে।