স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশের বারবার প্রতিবাদের পরও থামছে না সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আগ্রাসী মনোভাব। এবার মর্টার শেল ছোড়ার কয়েকদিনের মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অ্যাটাক হেলিকপ্টার বাংলাদেশের দিকে গুলি ছুড়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তর মংডু শহরতলীতে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে আরাকান আর্মি-এএ এবং মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে সীমান্তে বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমবু এলাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য দিল মোহাম্মদ আলম জানান, শুক্রবার রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার ৩৪ ও ৩৫ নম্বর সীমান্ত পিলারের মাঝামাঝি ১০-১৫টি গুলি ছোড়ে। গুলিবর্ষণের পাশাপাশি সারাদিন বিক্ষিপ্ত বিস্ফোরণের শব্দও ভেসে আসে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আমির হামজা বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ির অন্যান্য পিলারের মধ্যে গুলি ও মর্টার শেল ছোড়ার শব্দ আপাতত বন্ধ থাকলেও ৩৪ ও ৩৫ নম্বর পিলার পয়েন্টে বিস্ফোরণের শব্দ বন্ধ হয়নি। মাঝে মাঝে গুলিবর্ষণের শব্দ হচ্ছে থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না সীমান্তের এই অংশে বসবাসকারী আমরা সবাই আতঙ্কিত। স্থানীয়রা সকাল ৮টা, বিকেল ৫টা ১০ মিনিট, বিকেল ৫টা ২৮ ও সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মোট চারটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান বলে জানিয়েছে ইউএনবি।
এ বিষয়ে ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনের পর গত এক সপ্তাহ ধরে এখানকার পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত ছিল। তবে শুক্রবার রাতে আবার আচমকা মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়ার পর জনসাধারণের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস বলেন, শুনেছি শুক্রবার রাতে নাকি আবার মিয়ানমারের হেলিকপ্টার আমাদের সীমান্ত এলাকা অতিক্রম করেছে। আমাদের সীমান্তে বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিত টহল ও সতর্ক অবস্থায় আছে। জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।
এ ঘটনায় বিজিবি কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো: মেহেদী হাসান কবির গণমাধ্যমকে বলেন, শুক্রবার পর্যন্ত মিয়ানমারের কোনো হেলিকপ্টারের বাংলাদেশ ভূখ-ে প্রবেশের তথ্য পাইনি। হেলিকপ্টার মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই ছিল, তবে আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি এসেছিল। সীমান্তের সার্বিক নিরাপত্তায় ব্যাটালিয়ন ও সেনা সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। ২০১৭ সালের মতো আবার যাতে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করতে না পারেন, সেজন্য আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছি। সীমান্তে আমাদের টহল জোরদার করা হয়েছে।
কক্সবাজার অফিস থেকে গোলাম আজম খান জানান, তুমব্রু পশ্চিমকূল সীমান্তের ৩৩ ও ৩৪ নম্বর পিলারের পাশে বসবাস করেন আবদুর রশিদ। ঠিক তার বাড়ির বিপরীতে সীমান্ত ঘেঁষে মিয়ানমারের একাধিক বাংকার রয়েছে। এখান থেকে প্রতিদিনই ছোড়া হয় মর্টারের গোলা আর মাঝে মধ্যে হেলিকপ্টার থেকেও ফেলা হয় গোলা। তিনি বলেন, তুমব্রু পশ্চিমকূল সীমান্তের কাঁটাতার ঘেঁষে মিয়ানমারের অনেকগুলো বাংকার রয়েছে। যা আমার বাড়ির সীমানা থেকে দেখা যায়। আর মর্টারের গোলার বিকট শব্দগুলোতে কেঁপে উঠে বাড়িঘর। মিয়ানমার বাহিনীর কোনো রাত-দিন নেই; যখন খুশি তখন গোলাগুলি ও বাংকার থেকে গোলা মারছে।
আবদুর রশিদ আরো বলেন, মিয়ানমারের ঢেকুবনিয়া থেকে যে গোলা মারছে, তা সীমান্তের কয়েক কিলোমিটার অতিক্রম করে মিয়ানমারের পাহাড়ে পড়ছে। গোলাগুলি, মর্টার শেলের বিকট শব্দ আর যুদ্ধবিমান থেকে যে হামলা করছে এতে আমাদের দিন দিন আতঙ্ক বাড়ছে।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, মিয়ানমারের এমন কা-ে সচেতন রয়েছে সীমান্তের জনগণ। সীমান্তে বসবাস করছি সমস্যা হবে। তবে এটি দ্রুত সমাধানে সরকার কাজ করছে। আশা করি, সীমান্তের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে শিগগিরই।
এ ঘটনায় বিজিবি কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়ন সূত্র জানায়, সীমান্ত আইন লঙ্ঘন ও পূর্ব অনুমতি না নিয়ে সীমান্তে প্রতিদিন গোলাগুলি করার কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বিজিবি ইতোমধ্যে ১০টি পত্র ইস্যু করেছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রতিবাদ জানালেও মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি থামছে না। এ দিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তর মংডু শহরতলিতে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে আরাকান আর্মি (এএ) এবং মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এ ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয়দের বরাত দিয়ে মিয়ানমার নাউ জানিয়েছে।
সংবাদ মাধ্যমটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তাউংপিওলেটওয়েয়া শহরের এক মাইলেরও বেশি পূর্বে কুন থি পিনের নির্জন গ্রামের আশপাশে বেলা ১১টায় গুলি বিনিময় শুরু হয়। এক স্থানীয় ব্যক্তি বলেছেন, ‘আমরা ভারী ও হালকা অস্ত্রের একটানা গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। বেলা ১টার দিকে এটি থেমে যায়।’
কুন থি পিনে এক সময় এক হাজারেরও বেশি বাসিন্দা ছিল। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনীর গণহত্যার সময় তারা বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। গত ১৪ সেপ্টেম্বর আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, তারা সেনা চলাচল বন্ধ করতে জল ও স্থল উভয় দিকেই অভিযান চালাবে। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি মেদে গ্রামের কাছে সেনা, অস্ত্র ও রশদ বোঝাই সামরিক জান্তার দু’টি জাহাজ আটকে দিয়েছিল।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক সমন্বয়ের কার্যালয় মঙ্গলবার একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যের ছয়টি শহরে মানবিক সহায়তার বিধান বন্ধ করার আদেশ জারি করেছে। এগুলোর মধ্যে বুথিডাং, মংডু, মিনবিয়া ও মরাউক রয়েছে। আরাকান আর্মি ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে লড়াইয়ের কারণে উত্তর রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতিকে ‘অস্থির’ বলে বর্ণনা করেছে সংস্থাটি।