সিন্ডিকেট ও অবৈধ লেনদেন ঠেকাতে তৎপরতা
স্টাফ রিপোর্টার: প্রায় তিন বছর বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য খুলছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ডিসেম্বরে এ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হয়। এখন সমঝোতা বাস্তবায়নের মডালিটিজ কী হবে অর্থাৎ কর্মী বাছাই এবং নিয়োগের প্রক্রিয়া সংক্রান্ত একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছে দুই দেশ। একাধিক কূটনৈতিক সূত্র কুয়ালালামপুরের প্রস্তাব পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে। প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং এ নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর বিষয়টিও নিশ্চিত করেছে সূত্র। এ-ও জানিয়েছে, প্রস্তাবটি নিয়ে দুই দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী পর্যায়ে পরবর্তী আনুষ্ঠানিক আলোচনা হবে এবং সেখানে বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার পর যৌথ বিবৃতি প্রকাশের মধ্যদিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিস্তারিত উন্মোচিত হবে। সূত্র মতে, বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ সংক্রান্ত যে বৃহত্তর সমঝোতা সই হয়েছে তাতে নিয়োগের প্রক্রিয়ার মডালিটিজের বিষয়টি উভয়ের সম্মতিতে পরবর্তী আলোচনার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এখন সেই আলোচনাই চলছে।
মালয়েশিয়ায় এখন অন্তবর্তী সরকার রয়েছে, যা আগামী বছরেই পরিবর্তন হতে পারে। সেখানে নতুন মন্ত্রী এলে বর্তমান সরকারের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসতে পারে। তখন সমঝোতা ঠিক রেখে কেবল প্রটোকলে সংশোধনী আনলেই চলবে বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্র বলছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী নিয়োগে যাতে কোনো সিন্ডিকেট না হয় এবং কেউ অনৈতিক বা বাড়তি লেনদেনের সুযোগ না পায় সে বিষয়ে উভয় সরকার সচেতন রয়েছে। সিন্ডিকেট এবং অবৈধ লেনদেন ঠেকাতে দুই সরকারই সমানভাবে তৎপর। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অভিবাসন ব্যয় বাড়ানোর অভিযোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী গ্রহণ বন্ধ করে মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন মালয়েশিয়া সরকার। বহু সাধনার পর ডিসেম্বরে নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝোতায় উপনীত হয় বাংলাদেশ। এখন নিয়োগ সংক্রান্ত মডালিটিজ ঠিক হওয়ার পর পরই কর্মী পাঠানো শুরু হবে। ঢাকা চেষ্টা করছে নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে এবং কর্মীদের কুয়ালালামপুরগামী বিমানে তুলতে। মালয়েশিয়া বলছে, ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী যেকোনো বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে কাজের জন্য যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে, কিছু যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিয়েছে তারা। যার মধ্যে ভাষা শিক্ষা, ন্যূনতম ইংরেজির জ্ঞান মানে দেখে পড়তে পারার যোগ্যতা এবং অল্প বিস্তর মালয় ভাষা বুঝা বা শেখার আগ্রহ। মূলত কৃষি, নির্মাণ, খনি, গৃহকর্ম, বাগান, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ পাবে নতুন শ্রমিকরা। এসব কাজের ন্যূনতম অভিজ্ঞতা থাকতে হবে শ্রমিকদের। কারণ দেশটিতে নিয়োগের অন্যতম শর্ত হচ্ছে শ্রমিকদের দক্ষ বা সেমি-দক্ষ হতে হবে। মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নিয়োগ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আগেই বলা হয়েছে, সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশি কর্মীদের মালয়েশিয়া প্রান্তের সব খরচ নিয়োগকর্তা বহন করবেন। যেমন রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি নিয়োগ, মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়া, তাদের আবাসন, কর্মে নিয়োজিত করা এবং কর্মীর নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর খরচ বহন করবেন। নিয়োগকর্তা নিজ খরচে মালয়েশিয়ান রিক্রুটিং এজেন্ট নিযুক্ত করতে পারবেন। মালয়েশিয়ায় আসার পর বাংলাদেশি কর্মীর ইমিগ্রেশন ফি, ভিসা ফি, স্বাস্থ্য পরীক্ষার খরচ, ইন্স্যুরেন্স সংক্রান্ত খরচ, করোনা পরীক্ষার খরচ, কোয়ারেন্টিন সংক্রান্ত খরচসহ সব ব্যয় মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা বা কোম্পানি বহন করবে। নিয়োগকর্তা কর্মীর মানসম্মত আবাসন, বীমা, চিকিৎসা ও কল্যাণ নিশ্চিত করবেন। মন্ত্রণালয় আশা করছে, এর ফলে এখন বাংলাদেশি কর্মীদের মালয়েশিয়াতে অভিবাসনের খরচ অনেক কমে যাবে।
কবে থেকে যাওয়া শুরু হবে?
কবে থেকে বাংলাদেশের কর্মীরা মালয়েশিয়াতে যেতে পারবেন, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি। তবে এর আগে জানুয়ারির মধ্যেই সে প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে এমন কথা জানানো হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর আগে রিক্রুটিং এজেন্সি নির্বাচন এবং নিবন্ধন করানোর মতো কয়েকটি বিষয় চূড়ান্ত করতে হবে। মন্ত্রণালয় বলছে, তিন বছর আগে যে অভিযোগে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে মালয়েশিয়া (অর্থাৎ রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অভিবাসন ব্যয় বাড়ানোর অভিযোগ) এবার রিক্রুটিং এজেন্সির বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের কর্মী নিয়োগের বিষয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়েছিলো ১৯৯২ সালে। কিন্তু কয়েক বছর চলার পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০০৬ সালে আবার কর্মী প্রেরণ শুরু করে বাংলাদেশ। কিন্তু বিপুল সংখ্যক অবৈধ বাংলাদেশি ধরা পড়ার পর ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর আবার দু’দেশের মধ্যে আলোচনার পর ২০১২ সালে নতুন চুক্তি হয় বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে। কিন্তু কর্মী প্রেরণে সিন্ডিকেটের দৌরাত্মসহ নানা অভিযোগে ২০১৮ সালে সেটি বন্ধ করে মাহাথির মোহাম্মদের সরকার।
কর্মী নিয়োগের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালরা কর্মীদের পাসপোর্ট সংগ্রহ এবং বড় অঙ্কের টাকা নেয়ার বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মীদের কাউকে সরকারের চূড়ান্ত নির্দেশনার বাইরে না যেতে এবং অতিরিক্ত টাকা জমা না দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। খুব শিগগিরই সুস্পষ্ট বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে জানিয়ে বলা হয়েছে- কেউ অর্থকড়ি নিয়ে লেনদেন করে থাকলে তা হবে অবৈধ। এ নিয়ে সকলের জানার সুবিধার্থে নির্দেশনায় পুরো সিস্টেম সেট করে দেয়া হবে বলেও জানানো হয়। এ বিষয়ে মন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের অবস্থান হচ্ছে, ডেটাবেইজ তৈরি করে মালয়েশিয়ার চাহিদামতো লোক পাঠানো হবে। সরকারি ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত কেউ যেন একটি পয়সাও দালালকে না দেন সে বিষয়ে দফায় দফায় আগ্রহী কর্মীদের সতর্ক করা হচ্ছে। ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত না হলে কোনো কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারবে না বলেও সতর্ক করেছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।