স্টাফ রিপোর্টার: টাঙ্গাইলে যাত্রীবেশে বাসে উঠে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় সারা দেশে। এ ঘটনায় জড়িতদের ধরতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইতিমধ্যে জড়িত এক চালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার কাছ থেকে মিলেছে ডাকাতির স্বীকারোক্তি। তাকে নেয়া হয়েছে ৫ দিনের রিমান্ডে। বাসে থাকা যাত্রী ও ধর্ষণের শিকার নারীর জবানিতে মিলেছে ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা। বুধবার সকাল থেকে টাঙ্গাইলের আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে পুলিশি নিরাপত্তায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন ভুক্তভোগী নারী। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ডাকাতরা তিনটি স্থান থেকে বাসে উঠে এবং তাদের একজনের সঙ্গে সিটে বসা নিয়ে তার ও বাসের কন্ডাক্টরের তর্ক হয়। ওই নারী বলেন, ‘আমি কুষ্টিয়ার একটি জায়গা থেকে বাসে উঠি। সিরাজগঞ্জের হোটেলে রাত সাড়ে ১১টায় এসে পৌঁছাই। খাওয়া-দাওয়া শেষে গাড়ি চলতে শুরু করে। তার পাঁচ মিনিট পরে তিনটা ছেলে বাসে উঠে। তাদের বয়স ২০ থেকে ২২ বছর হবে। এরপর তারা বললো, আমাদের আরও লোক আছে সামনে। সামনে গিয়ে বাসে আরও চারটা লোক উঠে। তার মধ্যে আরেকজন বলে, সামনে আমার আরও লোক আছে। সিরাজগঞ্জের মধ্যে আরও ছয়জন উঠে। তাদের সিট পেছনে দেয়া হয়।’
এদিকে টাঙ্গাইলের মধুপুরে বাস ডাকাতি ও ধর্ষণের মামলায় মূল হোতা রাজা মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। বৃহস্পতিবার ভোরে টাঙ্গাইল শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিষয়টি টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বুধবার রাতে টাঙ্গাইলের মধুপুর থানায় মামলা হয়েছে। পরে মেয়েটিকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সুপার জানান, রাজা মিয়া কালিহাতী উপজেলার বল্লা গ্রামের হারুন অর রশিদের ছেলে। সে টাঙ্গাইল শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো। টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা রুটে ঝটিকা বাসের চালক ছিল সে। পুলিশ সুপার জানান, মধুপুরে বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান শুরু হয়েছে। রাতে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তিনি আরও জানান, অজ্ঞাত ১০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে। কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা বাসটিতে নাটোরের বড়াই গ্রামের বাসিন্দা ফল ব্যবসায়ী যাত্রী হাবিবুর রহমান গাড়িতে উঠেন রাত ১০টায়। তিনি নাটোরের তরমুজ চত্বর থেকে বাসে উঠেন। তিনি আমড়া, কাঁঠাল ও তাল বিক্রি করার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। ঈগল পরিবহনে অনেকদিন ধরে নিয়মিত যাতায়াত করা এই যাত্রী বলেন, আমরা বাসে উঠে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের বাসটি সিরাজগঞ্জের কাছাকাছি “দিবারাত্রি হোটেলে” রাতের খাবারের জন্য বিরতি দেয়। বাসের অনেকেই ওই হোটেলে খাবার খান। আমিও ওই বাসের সুপারভাইজার রাব্বি ও সহযোগী দুলালের সঙ্গে বসে খাবার খাই। আগে যে চালক বাস চালাতেন, আজ সেই চালক ছিলেন না। কড্ডার মোড়ে আসার পর গেঞ্জি, শার্ট পরা ১০-১২ জন যাত্রী গাড়িতে ওঠেন। তাদের প্রত্যেকেরই পিঠে ব্যাগ ছিল। তারা বাসের খালি সিটগুলোতে বসে পড়েন। বাসটি বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর যাত্রীবেশে ওঠা এই ডাকাত দলের সদস্যরা ঘুমন্ত যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে একে একে বেঁধে ফেলে। একই সঙ্গে প্রত্যেক যাত্রীর চোখ ও মুখ বেঁধে জিম্মি করে বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তারা। এমনকি শিশুদেরও একই কায়দায় বেঁধে রাখে তারা। পরে সব যাত্রীর কাছ থেকে মোবাইল, টাকা, গহনা লুট করে নেয়। তারপর নারী যাত্রীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।’ হাবিবুর রহমান নামে আরেক যাত্রী বলেন, ‘আমার পাশে বসা নারীকে চার দফায় ধর্ষণ করা হয়েছে বলে আমি অনুধাবন করতে পেরেছি। আমরা অসহায় ছিলাম। হাত, মুখ, চোখ বাঁধা ছিল। কিছুই করতে পারিনি। টানা তিন ঘণ্টা আমরা ওই বাসটিতে জিম্মি ছিলাম। বাসটি কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আমরা কিছুই জানি না। দুর্ঘটনায় শিকার হওয়ার পর আমরা জানতে পারি, টাঙ্গাইলের মধুপুরের রক্তিপাড়া এলাকায় আছি।’ বাসের নারী যাত্রী কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার তারাগুনিয়া গ্রামের শিল্পী বেগম বলেন, ‘আমি আমার অসুস্থ মেয়েকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের সবাইকে হাত, মুখ, চোখ বাইন্দা ডাকাতরা সব লুট কইরা নিছে। আমার স্বামী পিয়ার আলিকে ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। আমার কাছ থিকা ৩০ হাজার টাকা নিয়া গেছে।’ ওই বাসে থাকা অন্য নারী যাত্রীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে তিনি জানান। বাসের আরেক যাত্রী বেসরকারি চাকরিজীবী নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা আব্দুর রশিদ জানান, আমি নাটোর থেকে বাড়ি যাচ্ছিলাম অসুস্থ মাকে দেখার জন্য। সঙ্গে ছিল বেতনের ২২ হাজার ৮০০ টাকা। এর মধ্যে ১০০ টাকা রেখে বাকি পুরো টাকাই ডাকাতেরা নিয়ে গেছে।