ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনজীবনে পড়বে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব

কৃষিযন্ত্র সেচকাজে ও কৃষকের উৎপাদিত পণ্য পরিবহনেও ব্যয় বাড়বে
স্টাফ রিপোর্টার: দেশের সর্বাধিক ব্যবহৃত জ্বালানি ডিজেলের রেকর্ড ২৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনজীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির জের ধরে রোববার বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ এবং লঞ্চ ভাড়া ৩৫ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার। গণপরিবহনের ভাড়া বুদ্ধির এ হার নজিরবিহীন। আনুষ্ঠানিকভাবে বাস ও লঞ্চের রেকর্ড পরিমাণ ভাড়া বাড়ানোর প্রত্যক্ষ প্রভাব ছাড়াও দ্রব্যমূল্য, কৃষিপণ্য উৎপাদন ও পরিবহন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, মাছ আহরণসহ নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেচ মরসুমের ঠিক আগে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যয় বাড়বে কৃষিযন্ত্র ব্যবহার ও সেচকাজে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য পরিবহনেও ব্যয় বাড়বে। সরকার এ মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে আরও ‘ধীরে চল’ নীতিতে এগোতে পারত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সাধারণ মানুষের মধ্যে জোর আলোচনা- ডিজেলের এ মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকার ও পরিবহন মালিকরা লাভবান হলেও বলির পাঁঠা হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ডিজেলের এ বাড়তি দামের প্রভাব পুরোটাই সাধারণ মানুষের ওপর দিয়ে যাবে। তাদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। তারা এ বাড়তি মূল্যের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব নিয়ে আতঙ্কিত।
এদিকে চাপের মুখে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। যে হারে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে তার কঠোর সমালোচনা করেছেন নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্টজন, ভোক্তা অধিকার সংগঠন ও যাত্রী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন সিদ্ধান্তটি একতরফা। এতে যাত্রীদের স্বার্থ মোটেও গুরুত্ব পায়নি। এবারও যাত্রীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পরিবহন মালিকদের অন্যায্য চাপ মেনে নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বাস ও লঞ্চের একচেটিয়াভাবে বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাখ্যান করে ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে। সংগঠনটি অভিযোগ করেছে, মুনাফা লুটপাটের সুযোগ করে দিতে সরকার পরিবহন মালিকদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী একচেটিয়াভাবে বাস ও লঞ্চের ভাড়া বাড়িয়েছে। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় সংবাদ সম্মেলন করে তারা এ দাবি জানায়।
জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সাত বছর ধরে টানা মুনাফা করে গেছে। এই সময়ে সংস্থাটির মুনাফার পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারি তহবিলে জমা হয়েছে। দুই দফায় অর্থ মন্ত্রণালয় বিপিসি থেকে নিয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে সংস্থাটি জ্বালানি তেল বিপণনের বিপরীতে সরকারকে কর দিয়েছে বছরে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই জ্বালানি তেলের দাম না বাড়িয়ে অন্তত কয়েক মাস আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য পর্যবেক্ষণ করতে পারত বিপিসি। ডিজেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির আঁচ পড়বে বাজারে, বাড়বে পারিবারিক খরচ। জীবনযাত্রা আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। ফলে দেশের সব পরিবারেরই মাসিক খরচের হিসাব নতুন করে সাজাতে হবে। কৃষি ক্ষেত্রে সেচ পাম্প ও পাওয়ার টিলার ডিজেলে চলে বলে কৃষকেরও ব্যয় বাড়বে। মাছ ধরা ট্রলারগুলোরও জ্বালানি ডিজেল, তাই সেখানেও খরচ বাড়বে। সাগরে ইলিশ শিকারে যাওয়া জেলে নৌকাগুলো চলে ডিজেলে। তাদের খরচও বেড়ে যাবে অনেক। তেলের দামের প্রভাবে নৌযানের ভাড়া তো বাড়ানো হয়েছেই উপরন্তু ট্রাক ভাড়া বেড়ে গেলে শাকসবজি থেকে শুরু করে যেসব পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বাজারে আসে তার সবেরই দাম বাড়বে। অন্যদিকে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকশিল্পেও ডিজেলের দাম বৃদ্ধির আঁচ পড়বে। এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকায় বিদ্যুতের দাম বাড়ার শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। সরকারের এ ব্যয় বৃদ্ধির ঘোষণায় ভোক্তার জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে লোকসান কমাতে সরকার বুধবার মধ্যরাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকা করে। এর পরই শুক্রবার থেকে বাস চলাচল বন্ধ করে দেন পরিবহন মালিকরা। শনিবার দুপুরে ধর্মঘটে যোগ দেন লঞ্চ মালিকরা। তিন দিনের জিম্মিদশা পেরিয়ে ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর জেরে বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ এবং লঞ্চ ভাড়া ৩৫ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষক থেকে শুরু করে নাগরিক মধ্যবিত্ত ভোগান্তির শিকার হবেন সবচেয়ে বেশি। তারা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন সংসারের খরচ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কৃষকদের বড় খরচের খাত হলো সেচ কাজ। সেখানে ডিজেল ব্যবহার হয় বিপুল পরিমাণ। ট্রাক কিংবা নৌযানের ভাড়া বেড়ে গেলে শাকসবজি থেকে শুরু করে যেসব পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বাজারে আসে তার সবেরই দাম বাড়বে। ফলে ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত একটা চাপ তৈরি হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। যার ভুক্তভোগী হতে হবে সাধারণ মানুষকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্যমতে দেশে প্রায় ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডিজেল ও ২ লাখ ৭০ হাজার বৈদ্যুতিক পাম্প রয়েছে। প্রতি বছর গড়ে ১০ থেকে ১৬ লাখ টন ডিজেল সেচকাজে ব্যবহার করা হয়। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে ডিজেলের দাম বাড়ে। এবার পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে। দেশে জ্বালানি তেলের মোট চাহিদার ২১ দশমিক ১৫ শতাংশই ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সেচ খাতে। এ ছাড়া হালচাষ, মাড়াই, পরিবহন খাতসহ বিভিন্ন যান্ত্রিক খাতে ডিজেল ব্যবহৃত হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ডিজেল ব্যবহৃত হয়েছে ৯ লাখ ৭২ হাজার ৫৩৯ টন। এটি মোট চাহিদার ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রতি লিটার ৬৫ টাকা হিসেবে এ খাতে কৃষকের খরচ হয়েছে ৭ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে গত অর্থবছরের চেয়ে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে এ খাতে ডিজেলের চাহিদা ধরা হয়েছে ১১ লাখ টন। ৮০ টাকা হিসেবে এ খাতে কৃষকের খরচ হবে ১০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ বাড়ছে। এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা বাড়ায় ১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে। শুধু মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষি খাতে কৃষককে বাড়তি ২ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে।

Comments (0)
Add Comment