স্টাফ রিপোর্টার: ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকারের একাধিক সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানগুলোয় গত বুধবার থেকে বিশেষ তদন্ত শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও নিজ নিজ ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় অনুসন্ধান করছে। খোলা বাজারে ডলারের দাম নিয়ে কারসাজি বন্ধে পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) তদন্ত করছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, ব্যাংকারদের সংগঠন এবিবিও এ বিষয়ে কাজ করেছে। বৃহস্পতিবার বাজার ডলারের প্রবাহ বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রেখেছেন।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডিবি তথ্য পেয়েছে একটি চক্র বাজার থেকে অপ্রয়োজনে ডলার কিনে মজুত করছে। দাম বাড়লে সেগুলো বাজারে বিক্রি করে মুনাফা লুটে নেওয়ার জন্যই এসব করছে। এজন্য তিনটি চক্রকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কয়েকটি ব্যাংক। যারা মুনাফার জন্য অপেশাদারি আচরণ করেছে। একটি ব্যাংক নগদ ১০৪ টাকায় কিনে ১০৮ টাকায় ডলার বিক্রি করছে বলেও তথ্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া বেশকিছু ব্যাংক নগদ ডলার বেচাকেনার ক্ষেত্রে ২ থেকে ৩ টাকা মুনাফা করছে। দ্বিতীয় গোষ্ঠীর মধ্যে আছে, অসাধু মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে অনেকেই এ কা-ে জড়িত। তারাও ১০২ টাকা করে ডলার কিনে ১০৮ টাকায় বিক্রি করেছে। অনেকে অফিসিয়াল চ্যানেলে কম দামে ডলার কিনে খোলাবাজারে বেশি দামে বিক্রি করেছে। বাজারে সংকটের আভাস পেয়ে আগে থেকেই ডলার কিনে মজুত করেছে। এভাবে এক ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। এতে বাজারে দাম বেড়েছে। এরপর এখন তারা কম দামে কেনা ডলার বেশি দামে বিক্রি করছে। তৃতীয় পক্ষ হচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। যারা মূলত ডলারকে চাল, ডালের মতো নিত্যপণ্য মনে করে এই ব্যবসায় নেমেছে। তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ডলার কিনে মজুত করছেন। এছাড়া কিছু ব্যাংক প্রভাবশালী ও নিকটজনের কাছে বেশি মাত্রায় ডলার বিক্রি করেছে। সেগুলোও নেওয়া হয়েছে বেআইনিভাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ডিবি এ বিষয়গুলো তদন্ত করছে।
এর আগে গত মে মাসে খোলাবাজারে ডলারের দাম বাড়লে একটি গ্রুপ বাজার থেকে ডলার কিনে মজুত করে। ওই সময়ে প্রতি ডলারের দাম ১০৪ টাকায় উঠেছিল। পরে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপে কমে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, ডলার নিয়ে কারসাজি করলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে। ডিবি থেকে বলা হয়েছে, ডলার মজুত করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আরএফ হোসেন বলেছেন, একটি গোষ্ঠী বেআইনিভাবে ডলার মজুত করে বিপুল অঙ্কের মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। তারা পরিকল্পিতভাবে বাজার অস্থির করে তুলছে। এই গোষ্ঠীকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা উচিত।
এফবিসিসিআই-এর সভাপতি জসিম উদ্দিন, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার অস্থির করার পেছনে যেসব ব্যবসায়ী ও ব্যাংক দায়ী তাদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, ডলারের দাম বাড়ার কারণে এলসি খাতে সমস্যা হচ্ছে। দ্রুত এই সমস্যা নিরসনের জন্য ব্যাংকগুলোর প্রতি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
সরকারি সংস্থাগুলোর তৎপরতায় মানি চেঞ্জার্স ও খোলাবাজারে ডলারের দাম কিছুটা কমেছে। তবে ব্যাংকে আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। সম্প্রতি ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। খোলাবাজারে প্রতি ডলারের দাম গত মঙ্গলবার বেড়ে সর্বোচ্চ ১১২ টাকায় উঠেছিল। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ডিবি বাজারে অনুসন্ধান শুরু করলে এর দাম ১০৯ টাকায় নেমে আসে। বৃহস্পতিবার তা আরও কমে ১০৭ টাকায় নামে। ব্যাংকগুলোয়ও এখনো নগদ ডলার সর্বোচ্চ ১০৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ ব্যাংকে ১০৩ থেকে ১০৫ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে ডলারের সরবরাহ কমে যাওয়ায় চাহিদা বেড়ে যায়। এ কারণে ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এতে বাজারে দাম বাড়ছে হু হু করে। এক বছরের ব্যবধানে আন্তঃব্যাংকে ডলারের দাম প্রায় ১০ টাকা বেড়েছে। এক বছর আগে প্রতি ডলার ছিল ৮৬ টাকা। এখন ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। আমদানির জন্য প্রতি ডলার ছিল ৮৬ টাকা ৫০ পয়সা। এখন ৯৪ টাকা ৭৫ পয়সা। খোলাবাজারে ডলার ছিল ৮৭ টাকা। এখন ১০৭ টাকা।
সূত্র জানায়, বুধবার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১১টি পরিদর্শক দল মাঠপর্যায়ে তদন্ত করছে। তারা বিভিন্ন ব্যাংক ও মানি চেঞ্জারগুলোতে গিয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছে। এগুলো তারা এখন পর্যালোচনা করছে। পরিদর্শক দলের একটি অংশ বৃহস্পতিবারও বিভিন্ন ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানে হানা দেয়।
পরিদর্শকদের সূত্রে জানা গেছে, কার্ব মার্কেট থেকে একটি গ্রুপ সংঘবদ্ধ হয়ে ডলার কিনছে। এমন তথ্যও পাওয়া গেছে, ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নগদ ডলার কিনেছে। অনেকের মধ্যে গুজব রয়েছে, ব্যাংকে টাকা থাকলে তার কোনো মূল্য থাকবে না। মূল্যস্ফীতির কারণে টাকার মান অনেক বেশি কমে যাবে। যে কারণে তারা ডলার কিনে মজুত করছে। খোলাবাজারে ডলার কেনাবেচায় কোনো নিয়ম নেই। যে কারণে এখান থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশি তথ্য পাচ্ছে না। তবে ডিবি এ খাতে কাজ করছে। ইতোমধ্যে কারা ডলার কিনেছে, কেন কিনেছে, সেগুলো কি কাজে ব্যবহার করেছে-সংস্থাটি এসব তথ্যের অনুসন্ধান করছে। তাদের তৎপরতার পর এখন খোলাবাজারের ব্যবসায়ীদের দেখা মিলছে না। একই সঙ্গে খোলাবাজারে কেউ ডলার বিক্রি করতেও আসছেন না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে নগদ ডলারের দাম বাড়ানোর নেপথ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাত রয়েছে বলে উঠে এসেছে। এর মধ্যে একটি ব্যাংক এক দিনের ব্যবধানে নগদ ডলারের দাম ৬ টাকা বাড়িয়েছে। তারা ১০৪ টাকা করে নগদ ডলার কিনে ১০৮ টাকা করে বিক্রি করছে। প্রতি ডলারে মুনাফা করছে ৪ টাকা। কয়েকটি ব্যাংক প্রতি ডলারে ৩ টাকা মুনাফা করার তথ্যও মিলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এত মুনাফা করাকে অনৈতিক মনে করে।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে বেশ কিছু এলসি খোলা হয়েছে যেগুলো অপ্রয়োজনীয়। ব্যাংকগুলো এলসি খোলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানেনি। অনেক ব্যাংক নিজেদের কাছে ডলার থাকার পরও তা আন্তঃব্যাংকে বিক্রি করেনি। তারা ওইসব ডলার আগাম বিক্রি করেছে। যেগুলো পরে আবার নিজেরা কিনে কাজে লাগিয়েছে। এ ধরনের প্রবণতাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনৈতিক হিসাবে মনে করে।
ডলারের দাম বেশি রাখলে লাইসেন্স বাতিল-কেন্দ্রীয় ব্যাংক: ডলারের বাজারে কারসাজি প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউজের লাইসেন্স বাতিলের হুঁশিয়ারি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৃহস্পতিবার এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন তার সংগঠনের ৯ সদস্যকে নিয়ে দেখা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে। ডলারের দামে এ অস্থিরতা ঠেকাতে উদ্যোগ নিতে গর্ভনরকে অনুরোধ করেন এফবিসিসিআইয়ের প্রধান। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ডলারের দাম বাড়িয়ে যেসব মানিচেঞ্জার ও ব্যাংক মুনাফা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, ডলার বাজার স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। এ কাজে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। জড়িতদের চিহ্নিত করতে অভিযান অব্যাহত থাকবে। অনিয়মের প্রমাণ পেলে প্রয়োজনে লাইসেন্স বাতিলও করা হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে যে আতঙ্কের কথা বলাবলি হচ্ছে, তা অমূলক বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের রিজার্ভ যা আছে, সেটি ভালো। অনেক উন্নত দেশের চেয়েও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মজবুত।
তিনি বলেন, ‘আমরা একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে আছি। এটা ওভারকাম করতে পারলে সবকিছু স্বাভাবিক হবে। এমন অবস্থায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা দরকার।’