স্টাফ রিপোর্টার: ‘গাইবান্ধা উপনির্বাচনে ৯৮ নম্বর বড়াইকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হলেও তা স্থগিত করা হয়।’ সাদা কাগজে লিখিত বক্তব্য ও নিজের সই দিয়ে এ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধের আগের পরিস্থিতি জানান প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. মশফিকুর রহমান। এ কাগজে ভোট বন্ধের জন্য গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলামের নির্দেশনাকে দায়ী করেন। সে অনুযায়ী আনুমানিক বেলা ৩টার দিকে কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শুধু এটি নয়, এমন ৯৮টি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সাদা কাগজে লিখিতভাবে জানিয়েছেন তার কেন্দ্রে নির্বাচনের পরিবেশ ভালো ছিল। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার নির্দেশে তারা ভোট বন্ধ করেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলে আসছে ভিন্ন কথা। অনিয়মের চিত্র সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখার দাবি করে ৫২ কেন্দ্রের ভোট বন্ধের নির্দেশ দেয় ইসি। ভোট শুরুর প্রথম ঘণ্টা থেকেই পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কেন্দ্র বন্ধ করা হয়। দুপুর আড়াইটার দিকে সব কেন্দ্রের ভোট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এভাবে অনেক কেন্দ্রে ভোটের পরিবেশ ও ভোট বন্ধের কারণ নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। কোনো কোনো কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা দুই ধরনের তথ্য দেওয়ার কথাও সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, স্থানীয় প্রশাসনের চাপে তারা সাদা কাগজে নির্বাচনের পরিবেশ ভালো থাকার কথা উল্লেখ করে সই দিয়েছেন। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, উভয়পক্ষের বক্তব্য ও কার্যক্রমেই প্রমাণ করে ভোটের তথ্যে গরমিল আছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
সাদা কাগজে বেলা ৩টায় ভোটগ্রহণ বন্ধের বিষয় লেখার কথা স্বীকার করেছেন ৯৮নং কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. মশফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ওইদিন সন্ধ্যার দিকে বাসায় ঘুমে থাকাবস্থায় উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা আমাকে ফোনে ডেকে নিয়ে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল এটা লিখিত দিতে বলেন। সেদিন আমার চাচাতো বোন মারা যাওয়ায় আমার মাথা স্থির ছিলো না। তখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে অন্য একটি কপি দেখে লিখতে গিয়ে ভোটগ্রহণ বন্ধের সময় ভুলে বেলা ৩টা উল্লেখ করেছি। তিনি দাবি করেন, ভোটগ্রহণের সময়ের পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো ছিল। সকালে একটু ঝামেলা হলে পুলিশ দিয়ে ভোটারদের লাইন ঠিক করে দেন।
কখন ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুপুর ১২টার দিকে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম ইসির নির্দেশনা জানিয়ে ভোট শাটডাউন করার কথা বলেন। তিনি ভোট বন্ধের একটি নোটিশও কেন্দ্রে টানানোর নির্দেশ দেন। সেই অনুযায়ী ভোট বন্ধ করে নির্বাচনি সব মালামাল গুছিয়ে নোটিশ টানিয়ে দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে কেন্দ্র ত্যাগ করি। জানতে চাইলে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক মো. অলিউর রহমান বৃহস্পতিবার জানান, তার জানা মতে ১৪৫টি কেন্দ্রের মধ্যে কমবেশি ৯৮ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভোটের পরিবেশ ভালো ছিল উল্লেখ করে লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। ওই বক্তব্য তার কাছে রয়েছে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের এ ভাষ্য সরকার বা ইসিকে জানানো হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে এখনো জানাইনি। তিনি একটি অনুষ্ঠানে থাকায় এর বেশি কথা বলতে রাজি হননি। শুক্রবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও আর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সাদা কাগজে লিখিত নেয়ার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, এ ধরনের লিখিত নেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন কী স্থানীয় প্রশাসনকে অনুমতি দিয়েছে? প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা কী জানেন না কাকে নির্বাচনি পরিবেশ জানাতে হবে? কাউকে সম্বোধন না করে কেন তারা এমন লিখিত দিলেন? তিনি বলেন, একটি গণমাধ্যমের সংবাদে পড়লাম, কিছু কিছু কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। ভোট শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন বন্ধ হলো। তারপরও কীভাবে ফল ঘোষণা করা হলো? এটা নির্বাচন কমিশনের সম্পদ। ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যেসব কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরা ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি নষ্ট, অকেজো বা ভাঙচুর করা হয়েছে সেই তথ্য কী ইসিকে জানানো হয়েছে? ওই ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? তিনি বলেন, আমার মনে হচ্ছে, সেখানে ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ কারণে এ ধরনের নিয়মবহির্ভূত কর্মকা- চলছে।
১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএমে) ভোটগ্রহণ করা হয়। এ নির্বাচনের ১৪৫ কেন্দ্রের সবকটিতে এক হাজার ২৪২টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। রাজধানীর নির্বাচন ভবনে স্থাপিত মনিটরিং রুমে বড় পর্দায় ওইসব সিসি ক্যামেরার ফুটেজে বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র দেখে ধাপে ৫১টি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধের নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। আর রিটার্নিং কর্মকর্তা আরও একটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করেন। একপর্যায়ে দুপুর আড়াইটার দিকে পুরো নির্বাচনই বন্ধ করে দেয় ইসি। যদিও ওই ঘটনায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা ও স্থানীয় প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার ভোটগ্রহণ বন্ধের মতো পরিস্থিতি ছিল না বলে বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
এভাবে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা ভোটের পরিবেশ ভালো থাকার দাবি করার পরও নির্বাচন বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান বলেন, নির্বাচন কমিশন সিসি ক্যামেরায় অনিয়মের লাইভ দৃশ্য দেখার পর নির্বাচন বন্ধের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা ভোট সুষ্ঠু হওয়ার যে নোট লিখেছেন বলে শুনতে পাচ্ছি, সেটা কার কাছে দিয়েছেন। সেটা কী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দেওয়া হয়েছে? আমরা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ওই নোট পাইনি। তিনি বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদনে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো কর্মকর্তা সত্য লুকিয়ে থাকলে বা অনিয়মের মাধ্যমে ভোট নেওয়ার চেষ্টা করলে এবং তা তদন্তে প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনে আমাদের অবস্থানে আমরা অনড়।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ৯৪ নম্বর রামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রামনগর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট বন্ধের তথ্যেও গরমিল পাওয়া গেছে। ভোটগ্রহণ শুরুর ১ ঘণ্টা পরই ভোটারের আঙুলের ছাপে ইভিএমে ব্যালট ইস্যু করার পর সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিজেই ভোট দেন। এ ধরনের অনিয়মের চিত্র সিসি ক্যামেরায় দেখতে পায় ইসি। প্রথম এ কেন্দ্রটির ভোট বন্ধ করার নির্দেশ দেয় কমিশন। এরপরই ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম। ভোটগ্রহণ বন্ধের বিষয়ে গাইবান্ধা-৫ আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বরাবর দেয়া চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন-‘আনুমানিক সকাল ৯টার দিকে অনুমতিবিহীন ব্যক্তি গোপন কক্ষে প্রবেশ করায় ভোটগ্রহণ বিঘিœত হওয়ায় রিটার্নিং অফিসারের পরামর্শক্রমে উক্ত কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত/বন্ধ ঘোষণা করা হলো।’
এই কর্মকর্তাই আরেকটি সাদা কাগজে ভোটগ্রহণ বন্ধের কারণ নিয়ে ভিন্ন কথা লেখেন। কাউকে সম্বোধন না করেই লেখা ওই কাগজে মো. সাইফুল ইসলাম উল্লেখ করেন, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে চলছিল। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলামের নির্দেশনায় ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করেন। ২০১৪ জন ভোটারের মধ্যে সকাল ৯টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে প্রায় ৮১টি। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি ভোটগ্রহণ বন্ধের মতো কোনো পরিস্থিতি হয়নি বলে মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জানান, আনুমানিক সকাল ৯টা থেকে সোয়া ৯টার মধ্যে ভোটগ্রহণ বন্ধ করেছি। ভোট বন্ধের কারণ সম্পর্কে দুই ধরনের তথ্য উল্লেখ ও সাদা কাগজে কাকে সম্বোধন করে লিখেছেন-এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি ফোন লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দেন।
জানা গেছে, বোনারপাড়া রেল কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোটগ্রহণের অনিয়মের অভিযোগে দুপুর ১২টার দিকে বন্ধ করে দেয়া হয়। এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বিদ্যুৎ চন্দ্র সিংহ উল্লেখ করেছেন, ‘ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবে চলছিল। কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি।’ ভোটগ্রহণ দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে বন্ধ করার কথা জানালেও নির্বাচনি কর্মকর্তাদের নিয়ে বেলা ৩টায় কেন্দ্র ত্যাগ করার কথা উল্লেখ করেছেন। অনিয়ম হয়েছে দাবি করে ইসি ভোটগ্রহণ বন্ধ করলেও একই ধরনের তথ্য দেন ৭৯ নম্বর যোগীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. সামিউল ইসলাম। এছাড়া ৮১ নম্বর সাঘাটা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. রাশিকুর রহমান, ১০৯ নম্বর হলদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. মাছুদার রহমান প্রধান একই তথ্য দেন। ১১৩ নম্বর নলছিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা একেএম জুলফিকার হায়দারও একই তথ্য দেন। এ তালিকায় ১৩৮ নম্বর বোনারপাড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের মো. শহিদুল ইসলাম, ১৪৩ নম্বর দুর্গাপুর শাহজাহান আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কৃঞ্চ কমল সরকারসহ অনেকের নাম আছে।