স্টাফ রিপোর্টার: বিদ্যমান বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতি এবং ডলারের দামে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে শিল্প খাত ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছে। শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প খাতে উৎপাদন কমছে। কর্মীদের বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন সক্ষমতা কমছে। কিছু ইউনিট চালু রাখতে গিয়ে নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় খরচ আরও বেশি হচ্ছে। সব মিলে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এতে একদিকে পণ্যের দাম বেড়েছে। অন্যদিকে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে কমেছে পণ্যের বিক্রি। নয় মাসের মাথায় দ্বিতীয় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এ খাতে সংকট আরও বাড়ছে। আগামীতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। এটি হবে শিল্প খাতের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।
উদ্যোক্তারা বলেছেন, গত বছরের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ইতোমধ্যে শিল্প খাতে পড়েছে। ফলে সব শিল্পপণ্যের দাম বেড়েছে। ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব এখন পড়ছে। নতুন করে গত ৬ আগস্ট থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে ইতোমধ্যেই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগামী এক মাসের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও প্রকট হবে। সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বাড়ানোর কথা বলছে। এটি হবে শিল্প খাতের জন্য আরও বড় আঘাত।
সূত্র জানায়, করোনার সময় পণ্যের উৎপাদন ও বিপণন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। করোনার পর হঠাৎ করে চাহিদা বাড়ায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাব কাটতে না কাটতেই গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম আরও বাড়তে শুরু করে। গত এপ্রিল থেকে দেশে ডলারের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। এর মধ্যে গত নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম এক দফায় ২৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় বাড়ানো হয়েছে ৫২ শতাংশ। এসব কারণে শিল্প খাতে খরচ বেড়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, শিল্প খাতে এখন সংকট যেকোনো পর্যায়ে গেছে তা বলে বোঝানো যাবে না। যেভাবে খরচ বেড়েছে, সেভাবে পণ্যের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে লোকসানে পড়তে হচ্ছে। রপ্তানিমুখী শিল্পে সংকট আরও প্রকট। এখানে ইচ্ছে করলেই পণ্যের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে শিল্প খাত নিয়ে সরকারকে বসা উচিত। অন্য খাতের সঙ্গে এ খাতের তুলনা করলে চলবে না।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে গত দেড় বছরে শিল্পের যন্ত্রপাতির দাম গড়ে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। কাঁচামালের দাম বেড়েছে গড়ে ৫০ শতাংশ। গত এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ। জ্বালানি তেলের দাম দুই দফায় বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। গ্যাসের দাম একদফা বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রথম দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে পরিবহণ খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ। উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫ থেকে ১০ শতাংশ। এর ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্পের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এর প্রভাবে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর পণ্যের দামও বেড়েছে। দ্বিতীয় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে পরিবহণ ভাড়া বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। এর প্রভাবে ইতোমধ্যে খুচরা বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। উৎপাদন খরচ বাড়ায় কোম্পানিগুলোকেও পণ্যের দাম আরও এক দফা বাড়াতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সব মিলে রপ্তানি খাত এখন ভয়াবহ সংকট অতিক্রম করছে। এই সংকট দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে না পারলে ভবিষ্যতে সংকট আরও বাড়বে। কেননা বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো বিদ্যমান সংকট ভিন্নভাবে মোকাবিলা করছে। ফলে ওইসব দেশ বাংলাদেশের চেয়ে রপ্তানি বাজারে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে লোডশেডিং, জ্বালানি তেল, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করলে উৎপাদন কমবে এবং খরচ বাড়বে। বাড়তি খরচ দিয়ে পণ্য বিক্রি করা যাবে না। তখন এ খাতে সংকট আরও বড় হবে। সরকারকে এ বিষয়গুলো ভাবতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম ও দেশের বাজারে ডলারের দাম বাড়ার ফলে আগে ১০০ ডলার দিয়ে যে কাঁচামাল আমদানি করা যেত তা করতে এখন লাগছে কমপক্ষে ১৫০ থেকে ১৬০ ডলার। এতেও খরচ বেড়েছে।