বিদেশি মদ আমদানি কমে যাওয়ায় চাহিদা-জোগানে ফারাক
স্টাফ রিপোর্টার: করোনা মহামারি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কড়াকড়িতে বিদেশ থেকে মদ আমদানি অনেকটাই কমে গেছে। বিকল্প হিসেবে বেড়েছে স্থানীয় মদের চাহিদা। সে সুবাদে উৎপাদন ও বিক্রিতে রেকর্ড করেছে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় মদ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড ৮৩ বছরেরও বেশি পুরোনো প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই প্রথমবারের মতো বিভিন্ন ইউনিট থেকে প্রতিষ্ঠানটির মোট বিক্রি ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ বছর শুধু ডিস্টিলারি ইউনিট বা মদ বিক্রি থেকেই কেরু অ্যান্ড কোম্পানির আয় হয়েছে ৩৬৭ কোটি টাকা। লাভ হয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি, যা কোম্পানিটির আয়ে এযাবৎকালের রেকর্ড। গত বছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১০ লাখ প্রুফ লিটার বেশি মদ বিক্রি করেছে কেরু। কিন্তু বার ও রেস্তেরাঁগুলো চাহিদা অনুযায়ী তা পাচ্ছে না। ঢাকার কয়েকটি বারের কর্মীরা জানালেন, যতোটা তাদের চাহিদা, কেরু সে অনুযায়ী দিতে পারছে না। কেরুর এজেন্টদের কাছ থেকেও শোনা গেলো একইরকম কথা।
বাংলাদেশের অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, মদ কেনাবেচা, পান, পরিবহনের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা লাইসেন্স, পারমিট ও পাস থাকতে হয়। কখন মদ বিক্রি করা যাবে, কাদের কাছে বিক্রি করা যাবে, কোথায় বসে খাওয়া যাবে এর সবই সেখানে নির্ধারণ করে দেয়া আছে। বার ও রেস্তোরাঁগুলোতে দেশি কেরুর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বিদেশি মদও বিক্রি হয়। তবে বিদেশি মদ আমদানিতে ৬০০ শতাংশের বেশি শুল্ক দিতে হয় বলে দামও পড়ে অনেক বেশি।
নিয়মিত মদ্যপান করেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, মহামারী শুরুর পর থেকেই বিদেশি মদ পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে; কড়াকড়ির কারণে ওয়্যারহাউজগুলো থেকেও বিদেশি মদ পাওয়া যায় না। ফলে বারগুলোতে দেশি কেরুর চাহিদা বেড়ে গেছে।
শাহবাগ এলাকা সংলগ্ন পিককবারের কয়েকজন খদ্দের রোববার রাতে জানালেন, কেরুর মদ বেশি দামে পেগ হিসেবে বিক্রি হলেও পুরো বোতল বিক্রি হচ্ছে না। ফার্মগেইট এলাকার রেড বাটন এবং মগবাজারের পিয়াসী বারেও একই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেলো।
শাহবাগের সাকুরা রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারের ক্যাশের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, ‘কয়েক মাস ধরেই সমস্যাটা শুরু হয়েছে। কেরু ব্র্যান্ডের মদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা জোগান দিতে পারছি না। এই সঙ্কটটা কিন্তু শুধু পূজার জন্য নয়।’ কী কারণে সঙ্কট জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা এই মদ উৎপাদন করছে, তারাই বলতে পারবে।’
ঢাকার কলাবাগানের এফএল (অফ) শপ গ্রীন স্টোর লিমিটেড কেরুর মদের এজেন্ট। এর বিক্রয়কর্মী রানা ইসলাম গত মঙ্গলবার জানান, তারা মাসে প্রতি পারমিটের জন্য ৭ বোতল মদ বিক্রি করেন। সেই অনুযায়ী মাসে ৬০০ পারমিটের জন্য ৪ হাজার ২০০ বোতল মদ দরকার। ‘কিন্তু আমাদের দেয়া হচ্ছে এক হাজার থেকে ১২শ বোতল। এতে গ্রাহকরা যেমন ক্ষুব্ধ হচ্ছে; তেমনি আমরাও সমস্যায় আছি।’ অথচ রাষ্ট্রায়ত্ব কেরুর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, গত কয়েক বছর ধরে তাদের মদ উৎপাদন ও বিক্রি বাড়ছে।
দর্শনায় অবস্থিত খাদ্য ও চিনি শিল্প কর্পোরেশনের এ প্রতিষ্ঠান চলতি অর্থবছরে প্রায় ৭০ কোটি টাকা মুনাফার আশা করছে, যা গত বছরের দ্বিগুণের বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিক্রি প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানান কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, গত বছর ৫৪ লাখ লিটারের বেশি মদ বিক্রি হয়েছে তাদের। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই সাড়ে ১৪ লাখ লিটার বিক্রি হয়েছে।
গ্রীন স্টোরের বিক্রয়কর্মী জানান, বিদেশি মদ বিক্রি অনেকটাই সীমিত হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকরা কেরুর দিকে ঝুঁকছেন। তাই চাহিদা গেছে বেড়ে কিন্তু জোগান সে তুলনায় অনেক কম। কেরুর মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) শেখ মো.শাহাবুদ্দিনও এ কথায় সায় দেন। তিনি বলেন, ‘আগে বারগুলো বিদেশি মদ বিক্রিতে অভ্যস্ত ছিলো কিন্তু এখন অনেকেই হয়তো সেটা পারছে না। তাই কেরুর মদের চাহিদা বেড়ে থাকতে পারে। এজন্যই তারা বলছে যে মদের জোগান নেই।’
বাংলাদেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে বৈধভাবে এক লাখ ৫ হাজার লিটার অ্যালকোহল আমদানি হয়েছে। তবে অবৈধভাবে আসা বিদেশি মদের পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়। মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের অভিযানে, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সেখানে এখন টান পড়ায় চাহিদা বেড়েছে দেশি কেরুর।
মদ খাওয়ার অনুমতি পান কারা: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে হালনাগাদ ‘অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা’ জারি করেছে। মদ উৎপাদন, কেনাবেচা, পরিবহন, পান করার ক্ষেত্রে নিয়মগুলো সেখানে নির্ধারণ করে দেয়া আছে। বিধিমালায় বলা হয়েছে, ২১ বছরের কম বয়সীদের মদপানের পারমিট দেয়া যাবে না। অর্থাৎ, মদ পানের পারমিটের জন্য আবেদন করতে বয়স হতে হবে ২১ বছরের বেশি। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্যাক্রামেন্টাল ওয়াইন (আঙুরের নির্যাস থেকে তৈরি এক ধরনের মদ) ব্যবহারের জন্য বিশেষ পারমিট দেয়া যাবে। মদপানের অনুমতি পাবেন চা বাগানের শ্রমিকরাও। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য চোলাই মদের মহালের সংখ্যা ও অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে বিধিমালায়। আর মুসলমানদের ক্ষেত্রে সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার কোনো চিকিৎসকের সনদ প্রয়োজন হবে মদের পারমিট পাওয়ার জন্য। একজন পারমিটধারীর কাছে একবারে সর্বোচ্চ তিন বোতল এবং মাসে সর্বোচ্চ সাত বোতল অ্যালকোহল বিক্রি করা যাবে। তবে বিশেষ পারমিটধারীরা একবারে সাত বোতল কিনতে পারবেন। একই ব্যক্তিকে একই মেয়াদে বিদেশি ও দেশি মদের পারমিট দেয়া যাবে না। কোনো এলাকায় কমপক্ষে ১০০ জন মদের পারমিটধারী থাকলে সেখানে অ্যালকোহল বিক্রির লাইসেন্স দেয়া হবে। আর ২০০ জন হলে দেয়া হবে বারের লাইসেন্স। প্রতি শুক্রবার এবং মহররম, শবে বরাত, ঈদে মিলাদুন্নবী, শবে কদর, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা এবং সরকার নির্ধারিত দিনে মদের দোকান বন্ধ রাখার নিয়ম রয়েছে বিধিমালায়। বার কতোক্ষণ খোলা রাখা যাবে সেটাও বলে দেয়া হয়েছে। পারমিটধারী ক্লাব মেম্বাররা ক্লাবের নির্ধারিত স্থানে বসে মদ্যপান করতে পারবেন। যেসব ক্লাবে মদ্যপানের পারমিটধারী সদস্যের সংখ্যা ২০০ বা তার চেয়ে বেশি, সেসব ক্লাব তাদের চাহিদার ৪০ শতাংশ আমদানি করতে পারবে।
কেরু অ্যান্ড কোং: ১৯৩৮ সালে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তিগত উদ্যোক্তাদের অধীনে স্থাপিত হয়। সে সময় এর অধীনে একটি চিনি কারখানা, একটি ডিস্টিলারি ইউনিট ও একটি ওষুধ কারখানা যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সরকার এই প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে। দর্শনা কেরু এন্ড কোং লিমিটেডে নয়টি ব্র্যান্ডের ‘ফরেন লিকার’ বা বিদেশি মদ তৈরি হয়। চিনিকলে আখ থেকে চিনি বের করে নেয়ার পর যে উপজাত (চিটাগুড়, ব্যাগাস ও প্রেসমাড) পাওয়া যায় তা থেকে তৈরি হয় মদ। পাশাপাশি ভিনেগার, স্পিরিট ও জৈব সার তৈরি হয় ওই উপজাত থেকে। কেরুর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বছরে প্রায় ৩৯ লাখ ২০ হাজার বোতল ফরেন লিকার উৎপাদন করে তারা। আর বাংলা মদের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৬ লাখ লিটার, যা দেশের ১৩টি বিক্রয় কেন্দ্র থেকে বাজারজাত করা হয়।
উৎপাদন বাড়ছে, বিপণনেও পরিকল্পনা: কেরুর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশাররফ হোসেন জানান, গত কয়েক বছরে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির মদ বিক্রি বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এ বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর অবধি প্রায় ৬০ হাজার কেইস মদ বিক্রি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) বিক্রি ছিল ৩২ হাজার ৮৪৮ কেইস। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৪২ লাখ লিটার মদ বিক্রি হয়। মহামারীর সময়ে ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৫৪ লাখ ২৮ হাজার লিটার মদ বিক্রি হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের তিন মাসে উৎপাদন হয়েছে ১৪ লাখ ৬০ হাজার লিটার। মোশাররফ বলেন, ‘কেরু অ্যান্ড কোম্পানি মদের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আগামী জানুয়ারি থেকে অটোমেশনে উৎপাদন গেলে জোগান দ্বিগুণ হয়ে যাবে।’ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দর্শনা- এ তিনটি বিক্রয় কেন্দ্রের পাশাপাশি জোগান সহজলভ্য করতে কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় নতুন দুটো বিক্রয় কেন্দ্র করার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।