ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: করোনা পরিস্থিতির মধ্যে উভয় সংকটে পড়েছেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের বাসিন্দারা। তারা ঘরের বাইরে বের হতে পারছেন না করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ভয়ে। আবার পানি সংকটের কারণে তাদের ঘরে থাকাও অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অকেজো হয়ে পড়েছে অসংখ্য গভীর ও অগভীর নলক‚প। ফলে গৃহস্থলীর কাজে ব্যবহৃত ও খাবার পানি নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছেন তারা। এছাড়া বোরো ক্ষেতের শেষ মুহুর্তের পানি সেচ নিয়েও তাদের ভোগান্তির শেষ নেই। বিগত কয়েক দিনের দাবদাহে সকালে ক্ষেতে পানি সেচ দিলে পরের দিনই তা শুকিয়ে যাচ্ছে। শেষ মুহূর্তের বোরোক্ষেত ঠেকাতে কৃষকদের অনেকে বাধ্য হয়ে ৮-১০ ফুট মাটি খুঁড়ে গর্তের মধ্যে শ্যালোমেশিন বসিয়ে পানির স্তর পেতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, করোনার মহামারি থেকে বাঁচতে সবাই চাচ্ছেন নিজ ঘরে অবস্থান করতে। কিন্তু নলক‚পগুলোতে পানি না থাকায় তারা পড়েছেন ঝামেলায়। সরকারি ও স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা এখন বেশি করে হাত ধুতে হবে। পরিষ্কার রাখতে হবে পরিধান ও বিছানাপত্রের কাপড় কিন্তু নলক‚পে পানি না উঠাই চরম বিপাকে তারা। এখনো যেসব বাসাবাড়ির নলক‚পে পানি উঠছে সেখান থেকে নিয়মিত পানি নিতে যাওয়াটাও সবার জন্যই ঝামেলা। কালীগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলি অধিদফতরের পরীক্ষা নিরীক্ষা ও জরিপ মতে কালীগঞ্জ উপজেলায় মোট ২৯ হাজার ৫৬৩টি অগভীর নলক‚প রয়েছে। আর গভীর নলক‚প আছে ৩৮৪টি। গ্রীষ্মের শুরুতে প্রতি বছরের মতো এ বছরেও পানির স্তর বেশ নেমে গেছে। ফলে অনেক নলক‚পে পানি উঠছে না। অফিস সূত্রে আরো জানা যায়, বোরো চাষের কিছু কিছু এলাকাতে ৩৫ থেকে ৩৮ ফুট পর্যন্ত পানির স্তর নেমে গেছে। কালীগঞ্জ পৌর শহরের ফয়লা গ্রামের বাসিন্দা দলিল উদ্দীন সরদার, আড়পাড়া গ্রামের হাবিুবর রহমান জানান, তাদের মহল্লার বাসাবাড়ির বেশিরভাগ নলক‚পগুলোতে পানি উঠছে না। মোটরের মাধ্যমেও ঠিকমতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে তাদের এলাকাতে পৌরসভার স্পালাই পানিরও ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে মহল্লার অধিকাংশ পরিবার বাড়ি থেকে বেশ খানিক দূরের একটি সাব মার্সেপল মোটর থেকে পানি এনে খাবার পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন। গ্রামবাসীর পানির হাহাকারে ওই মোটরের মালিক সকাল ও বিকেল পানির ব্যবস্থা করছেন। রাজু আহম্মেদ জানান, গ্রামের কয়েকটি পরিবারের নলক‚পে পানি কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে প্রতিবেশি হলেও তাদের বাসা বাড়িতে যাওয়াটাও উভয়ের কাছে অনিরাপদ। তিনি বলেন, পানির অভাবে গোসল ও গৃহস্থলীর কাজের জন্য প্রতিনিয়ত ঝামেলা পোহাচ্ছেন। যতদিন ভারি বর্ষা না হবে ততদিন এমন অবস্থা বিরাজ করবে। একই এলাকার বাসিন্দা প্রভাষক আতিকুর রহমান জানান, বাসার নলক‚পে পানি উঠছে না। এ এলাকায় পৌরসভার সাপ্লাই পানির ব্যবস্থাও নেই। বাসা থেকে বেশ দূরের এক শিক্ষকের নির্মাণাধীন বাড়িতে স্থাপন করা একটি সাব মার্সেল মোটর থেকে সকাল বিকেল পানি টেনে বাসায় নিচ্ছেন। আর ওই গৃহকর্তা স্কুল শিক্ষক দাঁড়িয়ে থেকে এলাবাসিকে প্রতিদিন সকাল দুপুর সন্ধ্যায় পানি নিতে উৎসাহিত করছেন। তার এমন উদারতায় মহল্লাবাসী বেশ উপকৃত হচ্ছেন। এদিকে উপজেলার খড়িকাডাঙ্গা গ্রামের কৃষক আনছার আলী জানান, মাঠে দোল খাওয়া বোরো ক্ষেতের ধান তাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কিন্তু এ মৌসুমের শেষের দিকে এসে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। অল্প কিছুদিন পরেই ধান কাটা শুরু করা যাবে। কিছু কিছু ক্ষেতের ধান লাল হতে শুরু করেছে। তবে কিছু ক্ষেত আছে অনেক পরে লাগানো। সে ক্ষেতগুলোতে এখনো বেশ কয়েকটি পানি সেচ লাগবে। কিন্তু মেশিনে যেভাবে পানি উঠছে তাতে খুব সমস্যা হচ্ছে। সাদিকপুর গ্রামের কৃষক সাজেদুল ইসলাম জানান, আগে রোপণ করা কিছু ধানক্ষেত কাঁটার উপযোগী হলেও অধিকাংশ নাবী (পরে রোপণকৃত) বোরো ক্ষেতে এখনো চলছে শেষ মুহূর্তের সেচকাজ। কিন্তু পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ঠিকমতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তিনিসহ গ্রামের বেশিরভাগ কৃষক ১০-১২ ফুট গভীর করে খুঁড়ে শ্যালো মেশিন বসিয়ে খুব কষ্ট করে বোরো ক্ষেতের শেষ মুহুর্তের শেষ কাজ চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, শুধু তাদের মাঠেই নয়, এলাকার সব বোরো ক্ষেতের মাঠ গুলোর একই অবস্থা। কালীগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী জেসমিন আরা জানান, গ্রীষ্মের সময় এ অঞ্চলের পানির স্তর প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ ফুট নিচে নেমে যায়। এ অবস্থা হলেও পানি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এ বছর একটু আগে থেকেই পানির স্তর ৩০-৩৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। যে কারণে অনেক অগভীর নলক‚প অকোজো হয়ে পড়েছে। আবার গভীর নলক‚পগুলোতেও এখন অপেক্ষাকৃত কম পানি উঠছে। তিনি আরো জানান, গত সপ্তাহে উপজেলার বারোবাজারের একটি গ্রামে পানির স্তর মেপে দেখা গেছে ৩২ ফুট নিচে নেমেছে পানির স্তর। যে কারণে এ এলাকার অনেক নলক‚প অকেজো হয়ে গেছে। ফলে সংকট দেখা দিয়েছে খাবার পানির। এমনটি হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এ বছর এখনো বৃষ্টি না হওয়াই পুকুর খালবিলের জমে থাকা পানি শুকিয়ে গেছে। অনেক গ্রামের কৃষকেরা শ্যালোচালিত গভীর নলক‚পগুলো মাটি খুঁড়ে বেশ গভীরে বসিয়েও তেমন একটা পানি পাচ্ছেন না। তবে অল্প দিনের মধ্যে বৃষ্টি হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।