স্টাফ রিপোর্টার: প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা ঠেকাতে আজ থেকে টানা আট দিনের কঠোর লকডাউন শুরু। আগামী ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত আট দিনের জন্য নতুন করে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এ সময় জরুরি সেবা, গণমাধ্যম, নিত্যপণ্য, ওষুধ, খাবার দোকান বাদে যাত্রীবাহী পরিবহন, সব ধরনের দোকানপাট ও শপিং মল বন্ধ থাকবে। অবশ্য কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কল-কারখানা (বিশেষ করে গার্মেন্টস) খোলা রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সব প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। এ ছাড়া সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত ব্যাংকের লেনদেন চালু থাকবে। সব ব্যাংকের জন্যই এ নির্দেশনা প্রযোজ্য। শেয়ারবাজার চলবে সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। সর্বাত্মক লকডাউন নিয়ে গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এদিকে আট দিনের কঠোর বিধিনিষেধের আগ মুহূর্তে মানুষের ঢাকা ছাড়ার হিড়িক পড়ে। যাত্রীবাহী বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বন্ধ থাকায় ব্যক্তিগত প্রাইভেট কার, মাইক্রো, হায়াস, অটোরিকশা, সিএনজিসহ ছোট ছোট নানা পরিবহনে সাধারণ মানুষ ঢাকা ছাড়ে। কঠোর লকডাউনের আগের দিন রাজধানীতেও ছিলো তীব্র যানজট। ঢাকা থেকে বাইরে যাওয়ার বিভিন্ন পয়েন্টেও ছিলো ব্যাপক যানজট। শপিং মল, দোকানপাটসহ সব বিপণিবিতানে ছিল উপচে পড়া ভিড়। ব্যাংক পাড়ায় ছিলো লম্বা লাইন। চরম ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। কাঁচাবাজারসহ সর্বত্রই ছিলো মানুষের ঢল।
সরকার ঘোষিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কঠোর লকডাউনে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করবেন। সব ধরনের পরিবহন (সড়ক, নৌ, রেল, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে। ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি, অটোরিকশা, রিকশাসহ সব বাহনই বন্ধ থাকার নির্দেশনা রয়েছে। এ ছাড়া শপিং মল, মার্কেট, দোকান বন্ধ থাকবে। তবে পণ্য পরিবহন, উৎপাদন ব্যবস্থা ও জরুরি সেবাদানের ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য হবে না। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাসা থেকে বেরোতে পারবেন না। এক্ষেত্রে বাসা থেকে বেরোতে হলে মুভমেন্ট পাস লাগবে। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়।
তবে সর্বাত্মক লকডাউনে আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন-কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরগুলোর (স্থলবন্দর, নদীবন্দর ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যমের (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়া) পরিবহন ও অফিস, বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিস, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে। নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভূত থাকবে বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থলবন্দর এবং এ সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। তবে টিকা কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে টিকা গ্রহণের জন্য যাতায়াত করা যাবে। শিল্প-কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। তবে শ্রমিকদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা-নেয়া নিশ্চিত করতে হবে। শপিং মলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকবে। খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কেবল খাদ্য বিক্রয়/সরবরাহ (সরাসরি/অনলাইন) করা যাবে। কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বোরো ধান কাটার জরুরি প্রয়োজনে কৃষি শ্রমিক পরিবহনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন সমন্বয় করবে। সারা দেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসন উল্লিখিত নির্দেশনা বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত টহল জোরদার করবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক তার পক্ষে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেবেন। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে জুমা ও তারাবি নামাজের জমায়েত বিষয়ে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় নির্দেশনা জারি করবে। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ প্রয়োজনে সম্পূরক নির্দেশনা জারি করতে পারবে। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় গত ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে সাতদিনের লকডাউন বা বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। এই বিধিনিষেধের মেয়াদ শেষ হয় গত রোববার। বিধিনিষেধের সময়ে পালনের জন্য ১১টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ৪ এপ্রিল জারি করা প্রজ্ঞাপনে। এরপর একইভাবে বিধিনিষেধের আওতায় ছিলো গত দুই দিন। এদিকে বিধিনিষেধ শুরু হলে গণপরিবহন না পেয়ে দুর্ভোগে পড়েন খোলা থাকা সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মীরা। গণপরিবহন না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভও করেন যাত্রীরা। একই সঙ্গে দোকান ও মার্কেট খুলে দিতেও আন্দোলনে নামেন মালিক-শ্রমিকরা। এরই মধ্যে গত ৭ এপ্রিল সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে গণপরিবহন খুলে দেয়া হয়। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলাচল করছে বাস। তবে শপিং মল ও দোকান মালিক-শ্রমিকদের আন্দোলন চলছিলো। এরপর ৯ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট ও শপিং মল খোলা রাখা যাবে বলে গত ৮ এপ্রিল নির্দেশনা জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ সময়ে জরুরি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
লকডাউনে ব্যাংক ও পুঁজিবাজার খোলা : লকডাউনের মধ্যে ব্যাংক ও পুঁজিবাজার খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুই খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া ব্যাংকগুলোতে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত লেনদেন কার্যক্রম চলবে। এছাড়া আনুষঙ্গিক কাজের জন্য আড়াইটা পর্যন্ত খোলা থাকবে। এদিকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটি বাদে প্রতিদিন আড়াই ঘণ্টা করে দেশের দুই পুঁজিবাজার খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিএসইসির মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পুঁজিবাজার খোলা থাকবে। এক্ষেত্রে আগের মতো শেষের ১৫ মিনিট পোস্ট ক্লোজিং লেনদেন চালু থাকলেও প্রি ওপেনিং সুবিধা থাকবে না। ‘লকডাউনে’ ব্যাংক বন্ধের ঘোষণা এলেও সেই সিদ্ধান্ত কিছুটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত মেলে গতকাল দুপুরেই। জরুরি প্রয়োজনে ব্যাংক খোলার অনুরোধ জানিয়ে মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিবকে। চিঠিতে বলা হয়, ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারির জন্য আদেশক্রমে অনুরোধ জানানো হলো।
লকডাউনে স্বাস্থ্যসেবার সব প্রতিষ্ঠান খোলা : করোনাভাইরাসের মারাত্মক সংক্রমণ রোধে আজ শুরু হওয়া এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউনে স্বাস্থ্যসেবার সব ধরনের প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। সব অধিদফতর, দফতর ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ সময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে গতকাল অফিস আদেশ জারি করেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সামাল দিতে আজ থেকে এক সপ্তাহ সব ধরনের অফিস ও পরিবহন চলাচল বন্ধের পাশাপাশি বাজার-মার্কেট, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
জরুরি চলাচলে ‘মুভমেন্ট পাস’ চালু : কোভিড-১৯ মহামারীতে লকডাউনের মধ্যে মানুষের ‘অনিয়ন্ত্রিত ও অপ্রয়োজনীয়’ চলাচল কমাতে এবং জরুরি বিশেষ প্রয়োজনে যাতায়াতের সুবিধায় বাংলাদেশ পুলিশ চালু করছে মুভমেন্ট পাস। পুলিশ সদর দফতর থেকে জানানো হয়েছে, মুভমেন্ট পাসের ওয়েবসাইট চালুর প্রথম ঘণ্টায় আবেদন জমা পড়ে?ছে প্রায় সোয়া লাখের মতো। আর প্রতি মিনিটে প্রায় ১৫ হাজার আবেদন জমা হচ্ছে। দুপুরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস অডিটোরিয়ামে মুভমেন্ট পাস ওয়েবসাইটটির উদ্বোধন করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, যে কেউ এ ওয়েবসাইটে ঢুকে কয়েকটি তথ্য দিয়ে সহজেই এ পাস সংগ্রহ করতে পারবেন।
যেভাবে আবেদন করা যাবে : যঃঃঢ়ং://সড়াবসবহঃঢ়ধংং.ঢ়ড়ষরপব.মড়া.নফ/ ওয়েবসাইটে ঢুকে পাসের জন্য আবেদন করতে হবে। শুরুতে একটি সক্রিয় মোবাইল ফোন নম্বর দিতে হবে। আবেদনকারী কোথা থেকে কোথায় যাবেন, তা জানতে চাওয়া হবে। সেসব তথ্য ধাপে ধাপে দিতে হবে। এরপর আবেদনকারীর একটি ছবি আপলোড করে ফরমটি জমা দিতে হবে।
যেসব তথ্য লাগবে : আবেদনকারী কোন থানা এলাকা থেকে কোন থানা এলাকায় যাবেন তা উল্লেখ করতে হবে, আবেদনকারীর নাম, লিঙ্গ, বয়স, ভ্রমণের কারণ, পাস ব্যবহারের তারিখ ও সময়, পাসের মেয়াদ শেষের তারিখ ও সময়, পরিচয়পত্র, ছবি। পরিচয়পত্র হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধন বা স্টুডেন্ট আইডি কার্ড ব্যবহার করা যাবে।
যেসব ক্ষেত্রে লাগবে মুভমেন্ট পাস: মুদি মালামাল কেনাকাটা, কাঁচাবাজার, ওষুধ কেনা, চিকিৎসা, চাকরি, কৃষিকাজ, পণ্য পরিবহন, পণ্য সরবরাহ, ত্রাণ বিতরণ, পাইকারি/খুচরা ক্রয়, পর্যটন, মৃতদেহ সৎকার, ব্যবসাসহ অন্যান্য জরুরি কারণে বাইরে যাওয়ার জন্য পাসের আবেদন করা যাবে। ঢাকার বাইরে যাতায়াতে মুভমেন্ট পাস লাগবে। এ ছাড়া একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে একাধিক পাস নেয়া যাবে না। প্রতিবার যাতায়াতের জন্য পাস নিতে হবে, একটি পাস একবার ব্যবহার করা যাবে। যাওয়া এবং আসার জন্য দুটি আলাদা পাসের আবেদন করতে হবে। তবে সাংবাদিকরা মুভমেন্ট পাস প্রদর্শনের আওতামুক্ত থাকবেন বলে জানিয়েছেন বেনজীর আহমেদ।