স্টাফ রিপোর্টার: সীমান্তে একের পর এক সোনা উদ্ধার ও জব্দের ঘটনা ঘটছে। কখনো গাড়িতে বিশেষ কায়দায়, কখনো পেটের ভেতর বা পায়ুপথে, নারীদের গোপনাঙ্গে, স্যান্ডেল-জুতার ভেতরে নানা কায়দায় সোনা পাচার করা হচ্ছে। অনেক সময় পরিত্যক্ত অবস্থায় কেজি কেজি সোনা উদ্ধার করা হচ্ছে। এভাবে গত বছরে ১৮৫ কেজি (সাড়ে চার মণ) সোনা জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু অধরা থেকে যাচ্ছেন মূলহোতারা।
বিজিবির দক্ষিণ-পশ্চিম রিজিয়ন কমান্ডারের সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যশোর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও খুলনার অধিভুক্ত সীমান্তগুলো দিয়ে ভারতে পাচারকালে এই বিপুল পরিমাণ সোনা জব্দ করে বিজিবি। যার বাজারমূল্য দেড়শ কোটি টাকা। এর মধ্যে কয়েকটি চালান জব্দ করেছে যশোর জেলা পুলিশ। চোরাকারবারি আটক ও সোনা উদ্ধারে সাফল্যের প্রথম তালিকায় রয়েছে যশোর ৪৯ বিজিবি, দ্বিতীয় অবস্থানে ২১ খুলনা বিজিবি ব্যাটালিয়ন ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যশোর জেলা পুলিশ।
চোরাচালান প্রতিরোধে কাজ করা একাধিক সূত্র জানায়, এক পিস সোনার বার দেশের কুমিল্লা, চট্টগ্রাম বা ঢাকা যে পথেই প্রবেশ করুক না কেন পাচার হয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে অন্তত ৩০-৪০ জন কাজ করেন। কেউ বাহক, কেউ লাইনম্যান, কেউবা ইনফরমার। আবার কেউ কেউ বাহক বা লাইনম্যান ও ইনফরমারের ওপর গতিবিধি অনুসরণের কাজ করেন। প্রতি পিস বার পাচারের জন্য মূলহোতা পাচার কাজে নিয়োজিত একজনকে দায়িত্ব দেন। এজন্য তাকে দেয়া হয় তিন হাজার টাকা করে।
ওই টাকা থেকে বাহকসহ রাস্তায় নিয়োজিত ওয়াচম্যানদের দেয়া হয় এক হাজার। ওয়াচম্যানরা বিভিন্ন মোড়ে বা রুটে নির্দিষ্ট এরিয়ায় কাজ করেন। বিজিবি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ আসছে কি-না বা ওই রুটে সামনে কোনো বিপদ আছে কি না তা নির্দিষ্ট একটি বা দুটি মোবাইল নম্বরে জানিয়ে দেন তারা। তবে এর আগের বা পরের জনকে তা তারা জানতে পারেন না। তেমনি মূলহোতা কারা তাও তাদের জানতে দেয়া হয় না। তারা শুধু নির্দিষ্ট সময় তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন এবং তাদের ভাগের টাকা যথাযথভাবে বুঝে নেন। সে টাকাও গ্রহণ করতে হয় অপরিচিত মাধ্যম থেকে। এজন্য মূল হোতারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।
উদ্ধারের বাইরে সীমান্তের বিভিন্ন চোরাচালানি ঘাট ও আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে দীর্ঘদিন বিপুল পরিমাণ সোনার বার ভারতে পাচার করেছেন এক শ্রেণির চোরাকারবারি ও বহনকারীরা। তবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এসব অভিযানে শুধু বহনকারী শ্রমিকই আটক হয়েছেন। সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন মূল হোতারা।
কয়েকটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিজিবি ও যশোরের কয়েকটি থানার দেয়া তথ্যমতে, খুলনা বিভাগের ছয় জেলার মধ্যে সীমান্ত এলাকায় রয়েছে মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরায়। এসব সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন সোনার বড় বড় চালান পাচার হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
সোনা ও সোনার বার জব্দের তালিকায় সাফল্যের শীর্ষে রয়েছে যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়ন। এ ব্যাটালিয়নের অধিভুক্ত সীমান্তগুলো দিয়ে জব্দ সোনার পরিমাণ ৭৯ কেজি ৪৭৩ গ্রাম। যার বাজারমূল্য ৬৬ কোটি ৮৭ লাখ ৩৬ হাজার ৭০০ টাকা। এসব সোনা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকায় ১৬ জনকে আটক করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে খুলনা বিজিবি ব্যাটালিয়ন। এ ব্যাটালিয়নের অধিভুক্ত সীমান্তগুলো দিয়ে ভারতে পাচারের সময় জব্দ করা হয় ৪২ কেজি ৪০৭ গ্রাম সোনা। এসব সোনার বাজারমূল্য ৩০ কোটি ২৯ লাখ ৮২ হাজার ১৭৮ টাকা। আটক করা হয়েছে ১৮ জনকে।
একই সময়ে সাতক্ষীরা ৩৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিভুক্ত সীমান্তগুলো দিয়ে চার কেজি ৪৫১ গ্রাম সোনা জব্দ করা হয়েছে। যার বাজারমূল্য তিন কোটি ৭৬ লাখ ৩৫ হাজার ৩১৯ টাকা।
ঝিনাইদহর মহেশপুর ৫৮ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিভুক্ত সীমান্তগুলো দিয়ে ৩৮ কেজি ৪০ গ্রাম সোনা জব্দ করা হয়। যার বাজারমূল্য ২৬ কোটি ২৯ লাখ ১৪ হাজার ৪০১ টাকা। এসব সোনা পাচারের দায়ে আটজনকে আটক করা হয়েছে।
গত ১ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১২টার দিকে শার্শা উপজেলার সাতমাইল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৮ কোটি টাকা মূল্যের ৯ কেজি ৭৫৮ গ্রাম ওজনের ৩০টি সোনার বারসহ দুজনকে আটক করা হয়। এ সময়ে স্বর্ণ চোরাকারবারি ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত হন।
১৯ ডিসেম্বর বেনাপোল থেকে দুই কেজি সোনা নিয়ে যাওয়ার সময় পেট্রাপোলে একজন ভারতীয় ট্রাকচালককে আটক করে বিএসএফ। খালি ট্রাকটি তল্লাশি করে ট্রাকের নিচে বিশেষ কায়দায় লুকানো অবস্থায় সোনাগুলো জব্দ করা হয়। পরে চালক সাইফুল ম-লকে (৩৫) আটক করা হয়। ওই ট্রাকটি বেনাপোলে মালামাল আনলোড করে ভারতের পেট্রাপোলে যাচ্ছিলো।
গত ৫ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া সপ্তাহব্যাপী বিশেষ অভিযানের অংশ হিসেবে ৭ নভেম্বর সোর্সের মাধ্যমে তথ্য পেয়ে শার্শার গোড়পাড়া পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা লক্ষণপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন। ওইদিন বেলা ২টায় লক্ষণপুর আন্দলপোতা বেদেপুকুর এলাকা থেকে আটক করা হয় শার্শার টেংরালী ভেরদদারী পাড়ার মৃত আবু জাফর মল্লিকের ছেলে নাইম মল্লিক (২১) ও বহিলাপোতার টিলাপাড়ার শাহাজান মিয়ার ছেলে আজহারুল ইসলামকে (২২)। তাদের দখল থেকে ৬২ পিস বিভিন্ন আকারের ও ওজনের স্বর্ণের বার উদ্ধার হয়। যার ওজন ৭ কেজি ১২ গ্রাম। বাজারমূল্য আনুমানিক ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সবশেষ ২৪ ডিসেম্বর খুলনা ২১ বিজিবি বেনাপোলের পুটখালী সীমান্ত থেকে ১ কেজি ৯৮৩ গ্রাম ওজনের ১৭টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। আটক করা হয় মোটরসাইকেলসহ দুজনকে। পালিয়ে যান দুজন।
গত এক বছরে বিশাল পরিমাণ সোনা উদ্ধার ও ৫৫ জন আটক হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন মূলহোতারা। উদ্ধার ও আটককারী সংস্থা সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দিলেও পরবর্তী সময়ে পুলিশি তদন্ত দুর্বল হয়েছে। তদন্তের গভীরে না গিয়ে শুধু আটকদের নাম-ঠিকানা লিখে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। অনেক মামলার তদন্ত এখনো চলমান।
৭ কেজি সোনা চোরাচালান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শার্শা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুমন সরকার বলেন, তার কাছে থাকা মামলাটি যত্ন সহকারে তদন্ত চলছে। ওই সিন্ডিকেটে জড়িত বলে আরও অনেকের নাম এসেছে, যা যাচাই-বাছাই চলছে। একটি সুষ্ঠু তদন্ত করে গডফাদারের নাম বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই অভিযোগপত্র দেয়া হবে।
সীমান্তে চোরাচালান রোধে বিজিবি সবসময়ই কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান খুলনা ২১ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তানভীর রহমান।
তিনি বলেন, ‘বিজিবি অভিযান চালিয়ে সোনা জব্দ করে ও আসামির বিরুদ্ধে মামলা দেয়। এরপর এসব মামলার তদন্তভার পুলিশের ওপর বর্তায়। নেপথ্যে থাকা চোরাকারবারিকে সামনে আনবে তদন্তকারী ইউনিট। এরপরও বিজিবি সজাগ ও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’
আটক ও সোনা উদ্ধারে বেশি সাফল্য দেখানো যশোর ৪৯ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকী বলেন, তিনি ব্যাটালিয়নে যোগদানের পর থেকে সীমান্তজুড়ে চোরাচালান রোধে তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে এক বছরে সীমান্তজুড়ে অভিযানে বিপুল পরিমাণ সোনা জব্দ করা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে গত ১৬ নভেম্বর বেনাপোলের আমড়াখালিতে তল্লাশি চালিয়ে সাড়ে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে ১৬ কেজি সোনার চালান উদ্ধার ঘটনা ঈর্ষণীয়।
৫৮ বিজিবি ঝিনাইদহ মহেশপুর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহীন আজাদ বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান রোধে বিজিবি সদস্যরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
সাতক্ষীরা ৩৩ বিজিবির অধিনায়ক মেজর রেজা আহমেদ বলেন, চোরাচালান রোধে সাতক্ষীরা সীমান্তজুড়ে বিজিবি সবসময় সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। যে কারণে চোরাকারবারিরা এখন সাতক্ষীরা সীমান্ত রুট ব্যবহার করতে গেলেই ধরাশায়ী হচ্ছে। এ অঞ্চলে সোনা জব্দের হার অনেকাংশ কমেছে।
জানতে চাইলে বিজিবির দক্ষিণ-পশ্চিম রিজিয়ন কমান্ডার অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কে এম আজাদ বলেন, ‘এ অঞ্চলে রিজিয়ন কমান্ডারের সদর দপ্তর থাকায় সীমান্তগুলো দিয়ে সোনা পাচার অনেকাংশে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে। যেসব পাচারকারী এসব সীমান্ত দিয়ে ভারতে বা ভারত থেকে বাংলাদেশে সোনা ও মাদকদ্রব্য পাচারের চেষ্টা করছে সেগুলোও অহরহ ধরা পড়ছে। নেপথ্যে থাকা রাঘববোয়ালদের শনাক্ত করতেও কাজ চলছে।’