স্টাফ রিপোর্টার: সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের চরম গাফিলতিতে একের পর এক ঘটছে বড় বড় দুর্ঘটনা। দীর্ঘ হচ্ছে হতাহতের মিছিল। কিন্তু এতকিছুর পরও এক রকম ‘নীরব দর্শকের ভূমিকায়’ কর্তৃপক্ষ। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও উপেক্ষিত। যদিও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় সংশ্লিষ্টদের। গঠন হয় একের পর তদন্ত কমিটি। জমা পড়ে প্রতিবেদন। চিহ্নিত হয় দুর্ঘটনার কারণ। সমাধানে আসে নানা সুপারিশ। কিন্তু বাস্তবায়ন নেই এগুলোর। অধরাই থাকছে দায়ীরা। হচ্ছে দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
জানা গেছে, নির্মাণাধীন প্রকল্পের গার্ডার পড়ে এ পর্যন্ত ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে নিহত হয়েছে ২৩জন। আহত অর্ধশতাধিক। রাজধানীর নিমতলী, চুড়িহাট্টা, কামালবাগসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল ব্যবসার কারণে সৃষ্ট অগ্নিকা-ে গত এক দশকে জীবনপ্রতীপ নিভে গেছে দুই শতাধিক মানুষের। দগ্ধ হয়েছেন কয়েকশ মানুষ। জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, প্রকৌশলগত হিসাব অনুযায়ী নির্মাণ প্রকল্পের গার্ডার উঠানোর সময় ছুটে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতি ১০টি গার্ডার উত্তোলনের সময় একটি ছুটে যাওয়ার বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসাবে দেখা হয়। তবে নির্মাণকাজের সময় সে ধরনের নিরাপত্তা, সতর্কতা ও প্রস্তুতি রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, গার্ডার পড়ে হতাহতের ঘটনা আগেও ঘটেছে। সে সময় তদন্ত হয়েছে। কিন্তু দায় চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। এজন্য এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এ ঘটনারও তদন্ত হচ্ছে বলে জেনেছি, তদন্তে কারণ ও দায় চিহ্নিত করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। গত বছরের ১৪ মার্চ প্রথম বিআরটি প্রকল্পে গার্ডার ধসের ঘটনা ঘটে। একই দিনে দুবার বিমানবন্দর ও আব্দুল্লাপুরে দুটি গার্ডার ধসে পড়ে। এতে ৬ জন আহত হন। এখানে পথচারী ও প্রকল্পের নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। এরপর গত ১৫ জুলাই গাজীপুর শহরে বিআরটির গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে একজন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হন। সবশেষ গত সোমবার জাতীয় শোক দিবসের দিনে উত্তরায় ক্রেন থেকে প্রায় ৫০ টন ওজনের একটি গার্ডার সড়কে আচড়ে পড়ে যাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের ওপর। এতে ঘটনাস্থলে ৫ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রামের বন্দরহাট ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের সময় ২০১২ সালের ২৯ জুন প্রথম ১৩০ ফুটের কংক্রিটের গার্ডার নিচে পড়ে যায়। এরপর একই বছরের ২৪ নভেম্বর ওই ফ্লাইওভারের আরেকটি বিশালাকৃতির গার্ডার পড়ে ১৭ জন নিহত হন। ওই ঘটনায় আরও অনেকে আহত হন। এসব ঘটনার তদন্ত হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। পুরান ঢাকায় প্রায় ২ হাজার অবৈধ কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর অগ্নিকা-ের ঘটনার পর সরকার পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করে। এরপর এক দশকের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও কোনো কেমিক্যাল কারখানা স্থানান্তর হয়নি। এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নিমতলীর অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এতে ৭৮ জন প্রাণ হারায়। এরপর আবারও তোড়জোড় শুরু হয়। তদন্ত কমিটি হয়, প্রতিবেদনে নানা সুপারিশ করা হয়। ইতোমধ্যে প্রায় চার বছর অতিবাহিত হলেও পুরান ঢাকার অবস্থা সেই আগের মতোই রয়েছে। এ অবস্থায় সোমবার পুরান ঢাকার কামালবাগে প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৬ জন নিহত হয়েছে। এখন নতুন করে তদন্ত কমিটি হয়েছে। চলছে তোড়জোড়। এবারের তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে বিশ্বাস করে না নগরবাসী। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম-সম্পাদক ও নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক গুদাম সরানোর জন্য এখনো যথেষ্ট গুরুত্ব সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। এ কারণেই নিমতলী ও চুড়িহাট্টার মতো ট্র্যাজেডির পরও ওই এলাকার বাসিন্দারা রাসায়নিক গুদাম মেনে নিয়েই বসবাস করছে। এটার মূল কারণ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর অনীহা, অপারগতা ও অনিচ্ছা। সে কারণে এবং লোভের কারণে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা রাসায়নিককে সঙ্গে নিয়েই বসবাসে অভ্যস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, নিমতলীর ঘটনার পর কমিটি গঠন হলো, তদন্ত হলো, ২১ দফা সুপারিশ দিল কমিটি, প্রধানমন্ত্রী পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নিতে নির্দেশনা দিলেন। এরপরও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো সেসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকর অর্থে সক্রিয় হয়নি। এ কারণে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত না করায় এই অবস্থা চলতেই আছে। জানি না, কোথায় গিয়ে ঠেকবে। এ সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে এত এত বার বলেছি। কিন্তু সব অনিয়ম গা সওয়া হয়ে গেছে। কোনো প্রতিকার মিলছে না।