লক্ষাধিক মামলায় আসামি ৩৫ লাখের বেশি : নয়াপল্টনের সংঘর্ষে মামলা দায়ের
স্টাফ রিপোর্টার: হঠাৎ করেই আবারো মামলা ও গ্রেফতারের চাপে পড়েছে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। দলটির নেতাকর্মীদের মতে, তারা আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ অবস্থায় তাদেরকে চাপে রাখার জন্যই সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নতুনভাবে মামলা দিচ্ছে। কোথাও কোথাও পুরনো মামলাগুলো সচল করে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। ২০২১ সালের অক্টোবরেও সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি এবং গ্রেফতারকৃতদের বেশির ভাগই বিএনপির নেতাকর্মী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আপাতত বড় ধরনের কোনো কর্মসূচিতে নেই বিএনপি। করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রেখেছিল দলটি। গত বছরের শেষ দিকে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে সাংগঠনিক কর্মকা- আবার শুরু করে। তবে এই সময়ের মধ্যে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও পেশাজীবীদের সাথে মতবিনিময় করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। ওইসব বৈঠকের মতামত নিয়ে একটা খসড়া তৈরি করা হয়েছে। তা নিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত নেয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছে বিএনপি। এরপর চূড়ান্ত করা হবে আন্দোলনের রূপরেখা। পাশাপাশি সারা দেশে তৃণমূল পুনর্গঠনেও ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সব মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাদের সাথে ভার্চুয়াল বৈঠক করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বেশ কিছুদিন ধরে কমিটি গঠন ও পুনর্গঠনের খবরে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নিয়মিত যাতায়াত করে আসছেন। গত রোববারও স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠক করছিলেন তারেক রহমান। সে সময় ঢাকা মহানগর পশ্চিমের অন্তর্গত রূপনগর থানা ছাত্রদলের কর্মী সম্মেলনে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশের হামলার প্রতিবাদে সন্ধ্যা ৭টার দিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ছাত্রদল মিছিল বের করলে পুলিশ বাধা দেয়। পরে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব রফিকুল আলম মজনুসহ প্রায় ৩০ জন নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে বিএনপির দাবি।
এ ঘটনায় রোববার রাত ৯টায় জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, পুলিশের হামলায় ১৫ জনের অধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে। বিএনপি এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রায় ৩০-৩৫টি মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে পুলিশ। রফিকুল আলম মজনুকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করেছে। পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা ও মজনুসহ আটককৃত নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান রিজভী।
বিএনপির অভিযোগ, বিরোধীদেরকে মামলার জালে আটকানো সরকারের পুরনো কৌশল। মামলা দিয়ে বিএনপিকে কাবু রাখতে চায় সরকার। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে এক লাখ সাত হাজার মামলা দিয়েছে। এসব মামলায় ৩৫ লাখের বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলের প্রায় সব নেতাই কোনো না কোনো মামলার আসামি। অনেকের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলাও রয়েছে। এখনো এসব মামলায় অনেকে কারাগারে। মামলায় হাজিরা দিতে প্রায় প্রতিদিন কেন্দ্রীয়সহ তৃণমূল নেতাকর্মীরা আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন। কেউ কেউ পরোয়ানা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেক মামলার বিচারও শুরু হয়েছে। আবার পুরোনো অনেক মামলায় নেতাদের নামে পরোয়ানাও জারি হচ্ছে। দলটির নেতারা বলেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেক নেতাকে অযোগ্য করতে সরকার এসব মামলা দ্রুত শেষ করতে চায়।
এদিকে রোববার রাতে নয়াপল্টনে পুলিশ ও নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় রাজধানীর পল্টন মডেল থানায় পুলিশ বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেছে। এই মামলায় ৬২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৩০০-৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়া দিগন্তকে বলেন, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মামলা দিয়েছে। এসব মামলায় ৩৫ লাখেরও বেশি নেতাকর্মী আসামি। এই সংখ্যা বাড়বে বরং কমবে না। কারণ মিথ্যা মামলা দায়ের করা থামেনি। তিনি বলেন, আসলে মামলা ও গ্রেফতার জালে বিএনপিকে বন্দী করা আওয়ামী লীগের বেশ পুরোনো কৌশল। এর আগেও ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে গায়েবি ও মিথ্যা মামলা করেছে তারা। এসব মামলার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। আসলে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে তারা মামলাকে বেছে নেয়। কিন্তু কোনো কৌশল করেই তাদের শেষ রক্ষা হবে না।
বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ও একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, বিএনপি যখন দল গোছানোর কাজ প্রায় সম্পন্ন ও আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করেছে ঠিক সেই মুহূর্তে নেতাকর্মীদেরকে আবারো মামলার জালে আটকানোর জন্য সরকার পরিকল্পিতভাবে এগোচ্ছে। মামলায় বিএনপিকে জড়ানোর কৌশল হিসেবে অসংখ্য অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। যাদের নামে মামলা নেই তাদেরও আটক করে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। সরকারের মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় অনেকে গ্রেফতার আতঙ্কে এলাকাছাড়া। শুধু তৃণমূল নেতাকর্মী নন, কেন্দ্রীয় একাধিক নেতাও আছেন গ্রেফতার আতঙ্কে। যারা বাড়িতে আছেন তারাও রাতে ঘরে ঘুমাতে পারছেন না। তৃণমূলের সক্রিয় নেতাকর্মীদের তালিকা করে তাদের বাসায় প্রতিদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালাচ্ছেন।