স্টাফ রিপোর্টার: মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১৬৪২ জনকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে শুক্রবার দুপুরে প্রথম দলটি নতুন ঠিকানায় এসে পৌঁছায়। এদের মধ্যে পুরুষ ৩৬৮, নারী ৪৬৪ ও শিশু ৮১০ জন। স্বেচ্ছায় ভাসানচরে পৌঁছে অনেকেই স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তারা যেন নিজ দেশ মিয়ানমারে দ্রুত ফিরতে পারেন সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারসহ বিশ্বনেতাদের প্রতি আহবান জানান। বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন নয়, প্রত্যাবাসনই জরুরি। তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বৃদ্ধির ওপর জোর দেন তারা। প্রসঙ্গত, কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবির থেকে এক লাখ রোহিঙ্গা স্থানান্তরের প্রথম ধাপ এটি।
এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প থেকে রওনা দেয় রোহিঙ্গাদের প্রথম দল। তাদের স্বাগত জানাতে ভাসানচরে নানা ব্যানার ফেস্টুন লাগানো হয়েছে। আশ্রয় শিবিরজুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। করোনার কারণে জাহাজ থেকে নামার পর তাদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা হয়। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পর জেটি থেকে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় আবাসস্থলে। থাকার জন্য নতুন ঘর ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ পেয়ে আনন্দিত স্বেচ্ছায় ভাসানচরে আসা রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের বদ্ধজীবনে হাঁপিয়ে ওঠা শিশুরা উন্মুক্ত পরিবেশ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। জাহাজ থেকে নেমেই তাদের অনেকেই খেলায় মেতে ওঠে। চারদিকে খোলা জায়গা, নির্মল বাতাস, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত, ব্রিটিশ কোম্পানির ডিজাইনে পাকা ঘর, উন্নত স্যানিটেশন, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশসম্মত রান্নাঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, হাসপাতাল, বাজার এবং ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রসহ কী নেই এখানে। রয়েছে এতিমখানা, ডে-কেয়ার সেন্টার এবং সুপার শপের জন্য আলাদা ভবন। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের চেয়ে ১৮টি উন্নত সুবিধা রয়েছে ভাসানচরে। কক্সবাজারের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের কাছে এসব রূপকথার গল্পের মতো ছিলো। কিন্তু ভাসানচরে এখন তা বাস্তব। ফলে তাদের মধ্যে এই প্রকল্পের ব্যাপারে যে নেতিবাচক ধারণা ছিলো, বাস্তব অবস্থা দেখে তা দূর হয়ে গেছে।
কক্সবাজার বালুখালী ৯নং ক্যাম্প থেকে আসা মো. হাবিবুল্লাহ বলেন, আমরা ভালো থাকার আসায় স্বেছায় ভাসানচরে এসেছি। বাংলাদেশ সরকার এখানে আমাদের যে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে তা দেখে আমরা আনন্দিত। এজন্য বাংলাদেশের সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। নিজ দেশ মিয়ানমারে সরকার আমাদের নির্যাতন করেছে, হত্যা করেছে, ঘরছাড়া করেছে। আর বাংলাদেশের সরকার আমাদের নতুন জীবন দিয়েছে, ভাসানচরে নতুন ঘর দিয়েছে। আশা করি বাংলাদেশ সরকার আমাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে এসেছেন রমজান আলী। তিনি বলেন, আমি আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে মোট ৬ জন ভাসানচরের নতুন শহরে এসেছি। এখানে সবাই আমাদের স্বাগত জানিয়েছে। তারা আমাদের জন্য থাকার ঘর দিয়েছে। যা কক্সবাজারে চিন্তাও করা যায় না। এমন ঘর দিয়েছে, যা আমাদের মিয়ানমারের শহরেও নেই।
রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটি গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রামে বোটক্লাব থেকে তিনটি জাহাজ, আরআরবি জেটি থেকে একটি ও কোস্টগার্ড থেকে একটিসহ মোট ৬টি জাহাজ ভাসানচরেরর উদ্দেশে রওনা দেয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ৫টি ও সেনাবাহিনীর ১টি জাহাজ। এছাড়া নৌবাহিনীর ১২টি স্পিডবোট সার্বক্ষণিক পাহারায় জাহাজগুলোকে ভাসানচরে নিয়ে আসে। জাহাজে রোহিঙ্গাদের প্রথমে হালকা নাস্তা ও পরে দুপুরের খাবার দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার নৌবাহিনীর ২টি জাহাজে করে রোহিঙ্গাদের মালামাল আগেই পাঠানো হয়েছে।
প্রথম জাহাজটি বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে ভাসানচরের নৌবাহিনীর জেটি স্পর্শ করে। সেখানে নৌবাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা হাত নাড়িয়ে নতুন অতিথিদের স্বাগত জানায়। এরপর একে একে ছয়টি জাহাজ ভিড়ে ভাসানচরের জেটিতে। সেখান থেকে তাদের নেয়া হয় ওয়ারহাউসে। পরে ভাসানচর আবাসন প্রকল্পের পরিচালক নৌবাহিনীর কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরীর নেতৃত্বে কক্সবাজার থেকে আগত এক হুজুরের মাধ্যমে মোনাজাত করা হয়। এ সময় রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানানো হয়। এরপর তাদের ৭, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর ক্লাস্টারে তোলা হয়। এখানে মোট ১২০টি ক্লাস্টার হাউস আছে। এই চারটি ক্লাস্টারে মোট ৪৮টি বাড়ি। আর এই ৪৮টি বাড়িতে ৭৬৮টি রুম আছে। বৃহস্পতিবারই রুমগুলো বরাদ্দ দেয়ার পর বিকেলেই প্রত্যেক মাঝিকে (দলনেতা) রুমের চাবি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক সুবিধা সংবলিত পরিকল্পিত অস্থায়ী আবাসন প্রকল্প। ব্রিটিশ কোম্পানির ডিজাইনে শক্তিশালী বাঁধ দিয়ে দ্বীপকে সুরক্ষিত করা হয়। এছাড়া দ্বীপের চারদিকে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন। সাগরের মাঝে গড়ে ওঠা নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং পরিবেশসম্মত এই নগরীতে একসঙ্গে এক লাখ মানুষ থাকতে পারবে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩ হাজার ১শ’ কোটি টাকা। এই মেগা প্রকল্পটি নির্মাণ, বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। প্রশাসনিক বিষয়টি নজরদারি করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এই এলাকার মাটি, পানি এবং বাতাস মানুষের অত্যন্ত বসবাস উপযোগী হওয়ায় প্রকল্পের জন্য এই দ্বীপটিকেই বেছে নেয়া হয়েছে। এখানেও রেশন কার্ডের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের খাবার নিশ্চিত করা হচ্ছে। তবে তারা চাইলে বিশাল এই দ্বীপে অর্থনৈতিক কর্মকা-েও যুক্ত হতে পারবে। শুরুতে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এর বিরোধিতা করেছিলো। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলো আন্তর্জাতিক অর্থায়নে পরিচালিত এনজিওগুলো। তবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নমনীয় হয়েছে। এনজিওদেরও সুর পাল্টে যাচ্ছে। জানতে চাইলে ভাসানচর আবাসন প্রকল্পের পরিচালক নৌবাহিনীর কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী বলেন, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পরিবেশ ও অন্যান্য বিষয়ে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হয়েছে। এই প্রকল্প আমাদের অত্যন্ত পরিশ্রমের ফসল। নৌবাহিনীর সদস্যসহ সংশ্লিষ্টরা সব ধরনের ত্রুটি এড়িয়ে দিনরাত কাজ করে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। প্রথম পর্যায়ে ১৬৪২ জন নিজ ইচ্ছায় রোহিঙ্গারা এসেছে। পর্যায়ক্রমে আরও আসবে।