ঢাকা মেডিকেলে অধিকার পরিষদ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষ : ২২ নেতাকর্মী আটক
স্টাফ রিপোর্টার: ছাত্রলীগের হামলায় নিহত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে আয়োজিত সভায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় উভয় পক্ষের কমপক্ষে ১৬ জন আহত হয়েছে এবং ২২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে ৩টায় ‘আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদ’ এর আয়োজনে স্মরণসভাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছে বলে জানান আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদের আহ্বায়ক আখতার হোসেন।
এদিকে আহতরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলে সেখানে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের সময় ছাত্রঅধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আখতার হোসেনসহ অন্তত ১৫ জনকে পুলিশ আটক করেছে বলে জানান পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, তারা ২০-২২ জনকে আটক করেছে। শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে তাদের আটক করা হয়। আটকদের নেয়া হয়েছে শাহবাগ থানায়। অপরদিকে ওই ঘটনায় ছাত্র অধিকার পরিষদকে দায়ী করে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন নেতা।
এদিন সন্ধ্যায় সরেজমিনে দেখা গেছে, শাহবাগ থানার সামনে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জড়ো হয়েছেন। থানার মূল ফটক বন্ধ করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। ছাত্রলীগ নেতাদের অনুরোধে কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা থানার ভেতরে প্রবেশ করেন।
ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে বিকাল সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে স্মরণসভা করা হয়। এ সময় হঠাৎ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর হামলা চালান। এতে আহত হন আমাদের ১০-১৫ জন। তাদের ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু সেখানেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। এতে আমিসহ আমাদের অনেক নেতাকর্মী আহত হন।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের আটকে রাখলে পুলিশ এসে আমাদের প্রায় ১০ জনকে শাহবাগ থানায় তুলে নিয়ে যায়।’
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নাজিম উদ্দীন বলেন, ‘আমরা টিএসসিতে একটি প্রোগ্রামে আসছিলাম। সেখানে এসে দেখি বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে কর্মসূচি করছে। আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করি তারা ক্যাম্পাসের কি না। এ সময় তারা আমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সেøাগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে হামলা চালায় আমাদের ওপর। এতে আমিসহ ছাত্রলীগের কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনায় আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।’
শাহবাগ থানার ওসি নূর মোহাম্মদ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাসহ ২০-২২ জন নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। তাদের থানায় নিয়ে যাচাই-বাছাই চলছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়া চলমান। এ ছাড়া জড়িত আরও কয়েকজনকে আটকের চেষ্টা চলছে বলেও জানান ওসি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বেলা সাড়ে ৩টার দিকে নির্ধারিত কর্মসূচি সফল করতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন ‘আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদ’ নামক সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। তবে তাদের কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নাজিম উদ্দীনের নেতৃত্বে কয়েকজন গিয়ে তাদের বাধা প্রদান করে। এ সময় তাদের মধ্যে বাকবিত-া শুরু হয়। বাকবিত-ার একপর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা টিএসসিতে অবস্থানরত জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ডাক দেন।
এ সময় ওই হল ছাত্রলীগের সভাপতি কামাল উদ্দিন রানা ও সাধারণ সম্পাদক রুবেল হোসেনের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা এসে বেধরক মারধর শুরু করে। মারধরের একপর্যায়ে আহত হয়ে কেউ শাহবাগের দিকে আবার কেউ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে দৌড় দেন। তাদের পেছনে গিয়েও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বেধড়ক পেটাতে দেখা যায়। এ সময় তাদের হেলমেট, হাতে কাঠ, লাঠি, বাঁশসহ অবস্থান করতে দেখা যায়। হামলায় মাইক অপারেটর, রিকশাওয়ালা ও ছাত্রলীগের চারজনসহ উভয় পক্ষের কমপক্ষে ১৬ জন আহত হন।
আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদের অন্যতম সংগঠক আকরাম হোসেন বলেন, আমাদের কর্মসূচি শুরু না হতেই তারা আমাদের ওপর হামলা করে। আমাদের ব্যাপক মারধর করে। মারধরে আমাদের ১২জন নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে জাহিদ আহসান, হাসিবুল হাসান ও চার-পাঁচজনের অবস্থা বেশি গুরুতর। আহতরা ঢাকা মেডিক্যালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
এ বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, একটি দল ক্যাম্পাসে সব সময় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। অনুমতি না নিয়ে প্রোগ্রাম করলে যেকোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেটার দায় তাদের নিজেদের নিতে হবে।
এ দিকে আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগে নেয়া হলে সেখানেও উপস্থিত হন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপসমাজসেবা সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের নেতৃত্বে উপদফতর সম্পাদক আব্দুর রহিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বরিকুল ইসলাম বাঁধন, ফেরদৌস আলম, সুজন শেখ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পাদক আল আমিন রহমানসহ অনেক কেন্দ্রীয় নেতা এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাসপাতালের ভেতরে ছুটে যেতে দেখা যায়। এ সময় তাদের হাসপাতালের দরজায় মুহুর্মুহু আঘাত করতেও দেখা যায়। তারা ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে হাসপাতালের নিরাপত্তা রক্ষীরা অনুরোধ করে তাদের বাইরে বের করে গেট লাগিয়ে দেন। ওই পরিস্থিতিতে মেডিক্যালের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং রোগী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ফলে দুর্ভোগে পড়েন তারা।
তবে হাসপাতালে বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে ছাত্রলীগের উপ সমাজসেবা সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, আমরা টিএসসির একটা ঘটনায় আহত হওয়া আমাদের নেতাকর্মীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে এখানে নিয়ে এসেছি। কিন্তু তারা আমাদের দেখে হঠাৎ করে আমাদের ওপর চড়াও হয়ে ধাক্কা দিতে থাকে। এটা হাসপাতাল- একথা বারবার এটা বলা সত্ত্বেও তারা আমাদের ধাক্কা দিতে থাকে এবং মারতে আসে। ফলে হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট হয়।
ঘটনার পর হাসপাতালের বাইরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিলে ভেতরে আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদের নেতাকর্মীরা আটকে পড়ে। এরপর তাদের পুলিশ আটক করে। তবে তাদের গ্রেফতারের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি শাহবাগ থানা পুলিশ।
এদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা উল্লেখ করে মামলার প্রস্তুতি নিয়েছেন ছাত্রলীগের আহত সাংগঠনিক সম্পাদক নাজিম উদ্দীন। তিনি বলেন, আমরা টিএসসিতে একটা প্রোগ্রামের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম। তখন দেখি তারা রাজু ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আবরার ফাহাদের একটা প্রোগ্রাম করছে। সেখানে আমরা আখতার (ঢাবি ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি) ছাড়া আর কাউকে চিনি না। সব বহিরাগত নিয়ে এসেছে। তাই তাদের বললাম এখানে বিশৃঙ্খলা না করে চলে যেতে। কিন্তু তারা আমাদের গালাগাল করে এবং আখতারের নেতৃত্বে হত্যার উদ্দেশ্যে আমাদের ওপর হামলা করে। তাই আমরা মামলা করার উদ্দেশ্যে থানায় এসেছি।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় আবরারের বাবা চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। আসামিরা সবাই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতাকর্মী। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদ- দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান। এ মামলায় পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়।
ছাত্রদলের প্রতিবাদ : এ দিকে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রদল। রাত ৮টার দিকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতিতে প্রতিবাদ জানায় দলটি। যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের বর্বর নির্যাতনে নিহত শহীদ আবরারের হত্যাকারীদের উত্তরসূরি, আধিপত্যবাদের দোসররা বিনা উসকানিতে হামলা করে ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামীন মোল্লা, জাহিদ আহসান, সানাউল্লাহ, পারভেজ মাহমুদসহ অনেক নেতাকর্মীকে পিটিয়ে আহত করে। আরো গুরুতর বিষয় হচ্ছে, আহত নেতাকর্মীদের ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে নেয়ার পর সেখানেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হত্যার উদ্দেশ্যে নির্মমভাবে হামলা করে। মারধরের পর পুলিশ সদস্যরা হামলাকারীদের বদলে ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আখতার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আকরাম হোসেনসহ আক্রান্ত নেতাকর্মীদেরই গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
তারা আরো বলেন, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকেই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ কখনোই এদেশে বিরোধী মত সহ্য করতে পারেনি। সন্ত্রাস, রাহাজানি, অস্ত্রবাজির রাজত্ব কায়েম করে তারা শিক্ষাঙ্গনগুলোতে একচেটিয়া দখলদারিত্ব কায়েম রাখতে চায়। এই অপশক্তিকে প্রতিহত করতে তারা সব সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানান।