হরিণাকুণ্ডু প্রতিনিধি: ইট পোড়ানোর মরসুমে সতর্ক থাকতে হয় স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। হঠাৎ বাতাসে ভেসে আসে ধুলাধোঁয়া। আর তখনই শিক্ষকেরা বলতে থাকেন, ‘বাতাস শুরু হয়েছে, বাচ্চারা চোখ বন্ধ রাখো। ইটের ভাটার ধোঁয়া এদিকে ধেয়ে আসছে, তোমরা নাক চেপে ধরো।’ ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নে পার-মথুরাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এমন ভোগান্তিতে ফেলেছে আঙিনাতেই গড়ে ওঠা এক ইটের ভাটা।
শিক্ষকদের অভিযোগ, তাদের স্কুলের সীমানার ৬৫ ফুটের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে ভাটাটি। যেখানে গোটা মরসুম কাঠ পুড়িয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। এই ভাটার কালো ধোঁয়া আর উড়ে আসা বালু বিদ্যালয় ভবনে প্রবেশ করে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে। এতে প্রায় সময় শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। অথচ ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) ২০১৯ অনুযায়ী, বিশেষ কোনো স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা অনুরূপ কোনো স্থান বা প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। ইটের ভাটার কারণে পাঠদান ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি এলাকার লোকজন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিযোগ দেয়ার পর পরিবেশ অধিদপ্তর গত বছর ভাটাটি গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো। এ বছর ভাটাটি আবার চালু হয়েছে।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের যশোর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ বলেন, তারা মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করেন। তবে যশোর থেকে ঝিনাইদহসহ আরও কয়েকটি জেলা দেখতে হয়, যে কারণে সব সময় অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। উপজেলার পার-মথুরাপুর গ্রামে ঝিনাইদহ-হরিণাকুণ্ডু সড়ক ঘেঁষে ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পার-মথুরাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১০০ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়ে ২৯০ জন শিক্ষার্থীর লেখাপড়া করে। বিদ্যালয়টিতে ১২ জন শিক্ষক আর ৬ জন কর্মচারী রয়েছেন।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর রহমান বলেন, পাঁচ বছর আগে হঠাৎ ইটভাটার কাজ শুরু হয়। মেসার্স আসাদ জাহাঙ্গীর ব্রিকস নামের এই ভাটা প্রতিষ্ঠার সময় এলাকার লোকজন ও স্কুলের পক্ষ থেকে বাধা দেয়া হয়েছিলো। শুরুর দিকে ভাটাটা বিদ্যালয়ের কিছুটা দূরে শুরু করলেও ক্রমেই কাছে সরিয়ে নিয়ে আনা হয়েছে। এমন অবস্থায় বিদ্যালয়ে পাঠদান মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। এর প্রতিকার চেয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে অভিযোগ দিলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লাবনী খাতুন বলেন, বিষয়টি নিয়ে তারা খুব কষ্টে আছেন। ইটের ভাটা লোকালয়ের বাইরে স্থাপনের নিয়ম থাকলেও এটি করা হয়েছে স্কুলের সীমানা ঘেঁষে। এই ভাটার কারণে অনেক সময় বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রায়ই বাচ্চারা শরীর খারাপ লাগছে বলে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায়। মূলত ভাটার কালো ধোঁয়া আর উড়ে আসা বালুকণার কারণে বাচ্চারা অসুস্থ হচ্ছে।
সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী হাজেরা খাতুনের বাবা আকবার আলী বলেন, বিদ্যালয়ে বাচ্চা পাঠিয়ে তারা সারাক্ষণ চিন্তায় থাকেন কখন বাচ্চাটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিদ্যালয় এলাকায় গেলে পোড়ামাটির গন্ধ নাকে এসে লাগে। চোখ মেলে হাঁটাচলা করলে বালুকণা উড়ে এসে পড়ে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা কালো ধোঁয়ায়। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী মেঘনা খাতুন জানায়, তারা কষ্ট করে পড়ালেখা করে। বাতাস হলে চোখ মেলে চলাফেরা করা যায় না। কালো ধোঁয়া এসে শ্রেণিকক্ষে গন্ধ ছড়ায়। তাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। একই কথা জানাল নবম শ্রেণির ছাত্র রাকিবুল ইসলাম। ইটভাটাটির ব্যবস্থাপক আশরাফ উদ্দিন বলেন, ভাটাটি বিদ্যালয়ের আরও কাছে ছিলো। তারা অনেকটা সরিয়ে নিয়েছেন। এখন যে স্থানে আছে এতে খুব একটা সমস্যা থাকার কথা নয়। ভাটায় কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে তিনি জানান, তারা কয়লা ব্যবহার করছেন। কিন্তু কিছু কিছু সময় কাঠের ব্যবহার প্রয়োজন হয়। সে কারণে ভাটায় কিছু কাঠ মজুত রেখেছেন। ইটের ভাটা পরিচালনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আশারাফ বলেন, অধিদপ্তর কাউকেই অনুমোদন দিচ্ছে না।
চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন বলেন, মানবিক দিক বিবেচনা করে ভাটাটি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া উচিত।
ভাটাটির আশপাশে রয়েছে আরও দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আধা কিলোমিটার দূরে রয়েছে পারমথুরাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর শিতেলীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ভাটার আরও কাছে অবস্থিত। শিতেলীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, ভাটার কারণে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।