সাজার মেয়াদ শেষ হলেও স্বজনদের কাছে ফিরতে পারেননি ভারতীয় দু নাগরিক

স্টাফ রিপোর্টার:

‘আমি মার কাছে যাবো, তোমরা আমাকে মার কাছে নিয়ে চল, মার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’ দিনে-রাতে যতক্ষণ জেগে থাকেন, ততোক্ষণই যাকে কাছে পান, তাকে ধরেই অনবরত বলতে থাকেন কথাটি। এই আকুতি ভারতীয় নাগরিক আব্বাস মণ্ডলের (৩৩)। আব্বাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ভীমপুর থানার রাঙ্গেরপোতা গ্রামের মান্দার মণ্ডলের ছেলে। বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপরাধে চুয়াডাঙ্গার একটি আদালত ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর তিন মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন। সাজার মেয়াদ শেষে এ সংক্রান্ত বিষয়ে চিঠি চালাচালি হলেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সাড়া না পাওয়ায় সাড়ে তিন বছরেও আব্বাস স্বজনদের কাছে ফিরতে পারেননি। আব্বাস মণ্ডলের মতো স্বজনদের কাছে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন শেভরন কুমার (২৩) নামে আরও একজন ভারতীয় নাগরিক। শেভরন ভারতের বিহার প্রদেশের বাসিন্দা। তার বাবার নাম দেবনাথ ঋষি। মানসিকভাবে অসুস্থ হওয়ায় এর বেশি কিছু জানাতে পারেননি তিনি।

বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপরাধে নাটোরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (তৃতীয় আদালত) মো. আবু সাঈদ আসামি শেভরনকে এক বছর কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও সাত দিনের কারাদণ্ডাদেশ দেন। ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ায় তাকে দর্শনা চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে প্রত্যাবাসনের জন্য চলতি বছরের ৫ ফেব্রæয়ারি নাটোর জেলা কারাগার থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগারের কারাধ্যক্ষ শওকত হোসেন মিয়া বলেন, আব্বাস মণ্ডল অবিবাহিত। বাড়িতে তার বৃদ্ধা মা, তিন ভাই ও দুই বোন আছে। তিনি অনেকটাই কমবুদ্ধি সম্পন্ন। সারাক্ষণ শুধু মার কাছে যাবো, মার কাছে নিয়ে চল বলে কাঁদতে থাকেন। এছাড়া শেভরন মানসিকভাবে অসুস্থ। নাটোর জেলা কারাগারের তত্ত¡াবধানে পাবনার মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাও নিয়েছেন শেভরন। দুজনই হতদরিদ্র পরিবারের সদস্য হওয়ায় খোঁজখবরের বিষয়ে নিকটাত্মীয়দের তেমন আগ্রহ নেই। আবার বিএসএফের পক্ষ থেকেও তেমন সাড়া না পাওয়ায় প্রত্যাবাসনে খুবই সমস্যা হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগার সূত্রে জানা গেছে, আব্বাস মণ্ডল ২০১৮ সালের ৫ ফেব্রæয়ারি সীমান্ত পথে অবৈধভাবে বাংলাদেশ প্রবেশ করলে বিজিবির হাতে ধরা পড়েন। এ ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পাসপোর্ট অধ্যাদেশ ১৯৭৩-এর ১১ (১) (গ) ধারায় চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় একটি মামলা করা হয়। ৬ ফেব্রæয়ারি থানা-পুলিশ আদালতের মাধ্যমে আব্বাসকে বিচারাধীন বন্দী হিসেবে চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগারে পাঠায়। ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর ভারপ্রাপ্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (প্রথম আদালত) ফারিহা নোশীন বর্ণী আসামি আব্বাস মণ্ডলকে তিন মাসের কারাদণ্ড দেন।

আদেশে বলা হয়, আসামির হাজতবাস ইতোমধ্যে তিন মাসের অধিক সময় অতিক্রম করেছে। তার সাজাভোগ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এমতাবস্থায় অন্য কোনো মামলা না থাকলে স্বদেশে প্রত্যর্পণের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হলো। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশের অনুলিপি চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগারের কারা তত্ত¡াবধায়ক, ৬ বিজিবির অধিনায়ক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দেয়া হয়।

নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আদালতের এই আদেশের পরদিন ৯ অক্টোবর কারা তত্ত¡াবধায়ক মো. নজরুল ইসলাম ভারতীয় নাগরিক আব্বাস মণ্ডলকে ভারতে প্রত্যর্পণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও নির্দেশনা চেয়ে কারা মহাপরিদর্শককে লিখিত জানান। কারা মহাপরিদর্শকের পক্ষে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক মো. ইকবাল হাসান ২২ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবকে লিখিতভাবে জানান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মনিরা হক ৫ নভেম্বর এক চিঠিতে শর্তসাপেক্ষে আব্বাস মণ্ডলকে প্রত্যাবাসন করতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব, বিজিবির মহাপরিচালক, ভারতীয় হাইকমিশনার ও কারা মহাপরিদর্শককে লিখিত চিঠি দেন। শর্তগুলো হচ্ছে, কাছের চেকপোস্টের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন করতে হবে। প্রত্যাবাসন কার্যক্রম কারাবিধি মোতাবেক ও বিশেষ শাখার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে হতে হবে। সাজার মেয়াদ উত্তীর্ণ হতে হবে। অন্য কোনো মামলায় জড়িত থাকলে প্রত্যাবাসন করা যাবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাওয়ার পর আব্বাস মণ্ডলকে প্রত্যাবাসনে কারা তত্ত¡াবধায়ক মো. নজরুল ইসলাম ২০১৮ সালের ২৪ নভেম্বর এবং ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রæয়ারি চুয়াডাঙ্গার ৬ বিজিবি পরিচালককে পৃথক দুটি চিঠি দেন। বর্তমান কারাধ্যক্ষ শওকত হোসেন মিয়া ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর এবং সর্বশেষ ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর পৃথক তিনটি চিঠি দেন।

জানতে চাইলে ৬ বিজিবির পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ মোহাম্মদ ইশতিয়াক বলেন, তিনি মাত্র এক সপ্তাহ হলো যোগদান করেছেন। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগারের কারা তত্ত¡াবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) ও সহকারী কমিশনার বি এম তারিকুজ্জামান বলেন, সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় আইনি প্রক্রিয়া শেষে স¤প্রতি দুজন ভারতীয় নাগরিককে সেদেশে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। আব্বাস মণ্ডল ও শেভরনকে প্রত্যাবাসনে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

Comments (0)
Add Comment