ওসমান গণি: ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার ফতেপুর বকুলতলা বাজারে ঐতিহ্যবাহী চড়কপূজার মেলা আগামী বুধবার অনুষ্ঠিত হবে। ঝিনাইদহের জেলার মহেশপুর উপজেলাধীন ফতেপুর ঐতিহ্যবাহী চড়কপূজার মেলা ৩দিন ধরে হলেও এ বছর হবে ১দিন। বাংলাদেশের পঞ্জিকা অনুযায়ী ৩ বৈশাখ হিন্দুদের মতে ২ বৈশাখ রোজ বুধবার বকুলতলা বাজারে এই চড়কপূঁজা বা বানফোঁড় অনুষ্ঠিত হবে। চড়কপূঁজার উদযাপন কমিটির সভাপতি শ্রী সাধন কুমার ঘোষ জানান, দীর্ঘদিন ধরে চড়কপূঁজার উৎসব এখানে পালিত হয়ে থাকে। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এই উৎসব দীর্ঘদিন ধরে পালন করে আসছে তাই তাদের দেখাদেখি আমরাও এই উৎসবটি আনান্দের সাথে পালন করে থাকি। ২ বৈশাখ থেকে মেলা শুরু হয়ে চলে ২দিন ধরে। মেলার প্রধান আর্কষণ ২ বৈশাখ চড়কপূজা উপলক্ষে হিন্দু ধর্মীয় কিছু লোক সন্যাসী সেজে পিঠে লোহার বড়সি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে তুলে রসির সাথে বেঁধে ঘোরানো হয়। এবার একে একে ৭ জন সন্যাসীকে এভাবে পিঠে বড়সি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে তুলে ঘোরানো হবে।
এবার যারা সন্যাসী সেজেছেন বা পিঠে বরসি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে উঠে ঘুরবেন তারা হলেন, শ্রী অসিত কর্মকার (মনা), মহাদেব হালদার, বিপ্লব কর্মকার, সাধন বাবু রায়, ভিমহালদার, অধীর কুমার, বসুদেব। চড়ক পাক দেয়া হয় দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। প্রবীণ সন্যাসী মনা কর্মকার জানায় তিনি ৩ যুগের বেশি সময় ধরে বানফোঁড় করে আসছে। তার পূর্বপুরুষ এই বানফোঁড় বা চড়কপূঁজার করে এসেছে আমরা তাদের দেখাদেখি এই পূঁজা করে আসছি। দীর্ঘদিন করে আসলেও তার কোনো সমস্যা হয় না।
মেলার সভাপতি আরও জানান, তারা এই চড়ক পূঁজায় সন্যাসীদের পিঠে বড়সি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে তুলে ঘোরানোকে চড়কপূঁজা হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। এ বছর ১৬ এপ্রিল ৩ বোশেখ রোজ সোমবার সন্ন্যাসীদেরকে চড়ক গাছে ঘোরানো হবে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এই মেলাটি দেখতে আসেন। এমনকি পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এই মেলা উপভোগ করতে এসে থাকেন। তবে এ বছর এই চড়কপূঁজার গিড়ে যে মেলাটি হয় থাকে তার ওপরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কড়াকড়ি করা হয়েছে। যেকারণে কোন মেলার জমজমাট আসর বসবে না। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি শ্রী সাধন হালদার বলেন, এই মেলা আগে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে শ্রী অমুল্য বাবু জজ সাহেবের জমিতে হাট খোলায় অনুষ্ঠিত হতো (বর্তমানে আশ্রয়ণ প্রকল্প করা হয়েছে)। এরপর মহেশপুর চাঁদপুর দাসপাড়ায় (বর্তমানে কাশেম চেয়ারম্যান বাড়ি করেছে) এবং বকুলতলা বাজারে অনুষ্ঠিত হতো। এই চড়ক পূজার মেলা কখন থেকে কিভাবে শুরু হয়েছে তার সঠিক কোনো ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তবে প্রবীণ হিন্দুরা মনে করেন, ৪/৫শ বছর পূর্ব থেকে এই পূঁজা চলে আসছে। ব্রিটিশ আমলে ফতেপুরের জজ সাহেব শ্রী অমুল্য কুমার চট্রোপাধায়, কোলকাতা কলেজের অংক শাস্ত্রের শিক্ষাবিদ নগেন্দ্রনাথ মজুমদার, শ্রী মিলাম্বর মুখ্যোপাধ্যায়, কাশ্মীর মহারাজের মন্ত্রী পরে কোলকাতা মিউনিসিপ্যালের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, পি মুখার্জী তৎকালীন ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বঙ্গ দেশে উচ্চ পর্যায়ের সরকারি চাকরি করেন। এই সকল ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় সে সময় এই মেলা পরিচালিত হতো। বর্তমানে এখানকার হিন্দুরা ভারতে পাড়ি জমানোর কারণে মেলাটি অদূর ভবিষ্যতে বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়, সেন বংশের শাসন আমলে কাশ্মির থেকে চড়ক পূজা শুরু হয়। সে সময় শিব ভক্ত একজন হিন্দু ব্যক্তি কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে তাকে বিভিন্ন উপায়ে রোগ সারানোর চেষ্টা করা হয়। পরে তার পিঠে বরসি ফুঁটিয়ে রক্ত ঝরিয়ে শিবকে পূজা করার পর তার রোগমুক্তি হয়। সেখান থেকে এই চড়ক পূজার সৃষ্টি হয়েছে বলে এক ইতিহাস থেকে জানা যায়। তবে এ নিয়েও মতৈনক্য রয়েছে। আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এই মেলাকে কেন্দ্র করে পূরা চৈত্র মাস পাড়ায় পাড়ায় বালাকি গান করতো। সন্ন্যাসীরা গভীর রাতে শিবপূজা করতো এবং সপ্তাহ ধরে ফল-ফুল্ললী খেয়ে জীবন ধারণ করতো। পূজা কমিটির লোকজন ঢাকঢোল বাজিয়ে মেলার ২/৩দিন আগে ফতেপুরের কপোতাক্ষ নদ থেকে চড়ক গাছ তুলা হতো। এ বিষয়ে রয়েছে অনেক কিংবদন্তি। বর্তমানে চড়ক পূঁজা ছাড়া অন্যা কোন আনুষ্ঠানিকতা আর হয় না। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ক্রমান্বয়ে ভারত চলে যাওয়ায় মেলাটি আস্তে আস্তে ঐহিত্য হারিয়ে ফেলছে। পূজা কমিটির লোকজন এবারও বিপুল পরিমাণে লোক সমাগম হবে বলে আশা প্রকাশ করছিলো কিন্তু আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও অন্যান্য কারণে এটি সীমিত করা হয়েছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম হায়দার লান্টু জানিয়েছেন, এই উৎসব পালনের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতা করা হচ্ছে। পরিষদের পক্ষ থেকে তথ্য কেন্দ্র খোলা হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য গ্রাম পুলিশসহ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী মোতায়েন থাকবে।
এ দিকে এই মেলাকে কেন্দ্র করে মহেশপুর থানার অফিসার ইনচার্জ ফয়েজ উদ্দীন মৃধা জানান, পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।