ছেলের ছবি-ভিডিও দেখে দিন কাটে শহীদ রাকিবুলের মা-বাবার

স্টাফ রিপোর্টার: ‘৬ মাস ১৮ দিন পেরিয়ে গেলো। তবুও নিজেকে বোঝাতে পারি না। আমি যদি ঢাকায় চলে যেতাম তাহলে আমার সন্তান হয়তো আজ বেঁচে থাকতো। আমি কোনোভাবেই তাকে ঘর থেকে বের হতে দিতাম না। হারিয়ে ফেলা সন্তানের স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা কতো যে কষ্টের তা কেবল মা জানে। ছেলের ভিডিও, ভয়েস রেকর্ড ও ছবি দেখে দিন কাটে আমার।’ আহাজারি করে কথাগুলো বলছিলেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ রাকিবুল হোসেনের মা।
রাকিবুল হোসেনের (২৯) পৈতৃকবাড়ি ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকু-ু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে। বাবার নাম আবুবকর সিদ্দিক (৬৫) ও মায়ের নাম হাফিজা খাতুন (৫৭)। শহীদ রাকিবের মা ক্যানসার আক্রান্ত। সাড়ে ৬ বছর ধরে তিনি ক্যানসারের চিকিৎসা নিচ্ছেন। রাকিবুলের একমাত্র ভাই ইকবাল হোসেন (৩৭) পেশায় ব্যাংকার। ঝিনাইদহ পৌরসভার মহিষাকু-ু গ্রামে শহীদ রাকিবুলের পরিবারের বসবাস।
শহীদ রাকিবুলের মা হাফিজা খাতুন জানান, রাকিবের বন্ধু পিয়াস প্রথম বাড়িতে খবর দেয়। পরে রাকিবের অফিসের কর্মকর্তারা পিয়াস, সালমান ও ফয়সালকে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে মরদেহ ঢাকা থেকে ঝিনাইদহে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সালমান ও পিয়াস রাকিবের সহকর্মী। হরিণাকু-ু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে শহীদ রাকিবকে দাফন করা হয়।
জানা গেছে, গত বছরের জুলাইয়ে ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রাকিবুল হোসেন। ১৯ জুলাই মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নেন ইঞ্জিনিয়ার রাকিবুল হোসেন।
শহীদ রাকিবুল হোসেনের বাবা আবু বকর সিদ্দিক ও মা হাফিজা খাতুন জুলাইয়ের ভয়াল সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে এখনও ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ছেলের ভিডিও, ভয়েস রেকর্ড ও ছবি দেখেই দিন কাটে তাদের।
রাকিবুলের বাবা আবুবকর সিদ্দিক বলেন, ‘৬ মাস পেরিয়ে গেলো। আমার ছেলের স্মৃতি একটা মুহূর্তও ভুলতে পারি না। ঘুমাতে পারি না। খেতে পারি না। আমার ছেলের শোয়ার ঘরে সবকিছু পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে। আমার ছেলেটাই কেবল নেই। পড়ার টেবিল, হেলমেট, বইপত্র দেখলেই বুক ফেটে কান্না আসে। কান্না ছাড়া তো আর কোনো কিছুই নেই আমাদের।’
বিমানবাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমরা রাকিবকে ফোন করলে সে বলতো বাসায় আছে। কিন্তু অফিস শেষ করে ছাত্রদের আন্দোলন দেখতে যেত। ছাত্রদের পানি, বিস্কুট খাওয়াতো। এসব কথা রাকিবুলের সহকর্মীরা আমাদের জানিয়েছে।’
শহীদ রাকিবুলের মা হাফিজা খাতুন বলেন, ‘১৮ জুলাই ঢাকায় যখন আন্দোলন শুরু হয়। তখন আমি খুব ভয়ে ছিলাম। শুধু ভাবতাম আমার রাকিব অফিসে যাবে কীভাবে? ১৯ জুলাই শুক্রবার রাকিবকে ফোন করে বললাম, আব্বু অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে না? রাকিব বলেছিলো, না। ১৮ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাকিব আন্দোলনে যায়। ওইদিন তার বুকে রাবার বুলেট লাগে। রাতে বাসায় ফিরে আমার সঙ্গে কথাও বলেছে। কিন্তু আমাকে কিছুই বুঝতে দেয়নি।’-বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রাকিবুলের মা। তিনি বলেন, শুক্রবার রাত ৮টার দিকে একমাত্র ভাতিজির (বড় ভাইয়ের মেয়ে) সঙ্গে রাকিবের শেষ কথা হয়। কথা বলার সময় ভাতিজি তাকে বলেছিলো, ‘ছোট আব্বু তুমি বাড়ি চলে আসো। গাড়ি না পেলে তোমার বাইক নিয়ে চলে আসো। না হয় তুমি অ্যাম্বুলেন্সে বাড়ি চলে আসো। কে জানতো অবুঝ ভাতিজির সেই অস্পষ্ট ইঙ্গিত বাস্তবে পরিণত হবে। রাকিব বাড়ি ফিরেছে ঠিকই। প্রিয় বাইক কিংবা গাড়িতে নয়, নিথর দেহে অ্যাম্বুলেন্সে চেপে।
হাফিজা খাতুন বলেন, ‘শুক্রবার মিরপুরে মেট্রোরেলের নিচে আন্দোলনকারীদের মাঝে আমার ছেলে পানি ও বিস্কুট বিতরণ করছিলো। শিক্ষার্থীদের মাঝে সে যতোক্ষণ ছিলো, ততোক্ষণ নিরাপদই ছিলো। যখনই সে পানি বিতরণ শেষে শিক্ষার্থীদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে যায়, তখনই তাকে টার্গেট করে গুলি করা হয়। মেট্রোরেলের ওপর থেকে তার গলায় গুলি করা হয়।’
রাকিব ঝোল গুড়, নারকেল ও পুলিপিঠা পছন্দ করতো জানিয়ে রাকিবুলের মা বলেন, ‘আমার ছেলেটার জন্য দুধ, নারকেল, ঝোল গুড়, আটা গুছিয়ে রেখেছিলাম। সেগুলো আজও সেরকমই রেখে দেয়া হয়েছে। কীভাবে আমি ওই খাবারগুলো খাবো? এই খাবারগুলো আমি স্পর্শ করি, আর কাঁদি। কান্না ছাড়া আর কী আছে জীবনে?’
শহীদ রাকিবুল হোসেনের মা-বাবার চাওয়া একটা মানবিক, সহিষ্ণু ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র। তাদের সন্তান জীবন দিয়েছে, হাজারো মায়ের বুক খালি হয়েছে। যারা শহীদ হয়েছে, তাদের আকাক্সক্ষা যেন পূরণ হয়। রাষ্ট্র যেন নতুন স্বাধীনতার সুফল জনগণের মাঝে পৌঁছে দেয়।