স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা মাসিকসভায় যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে তুলনামূলক চুরি ও অপরাধ প্রবণতা একটু বেড়েছে আবার ২০২৩ ডিসেম্বরের তুলনায় কমেছে। আসলে সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় কিন্তু সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করা সহজ হয়। তাই আমাদের সকলের চেষ্টা থাকবে যে যার জায়গা থেকে পুলিশকে সহযোগিতা করা। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজ থেকে সকল অপরাধ দূর করা সম্ভব। গতকাল রোববার সকাল ১০টায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিকসভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি উপরোক্ত কথাগুলো বলেন। সভায় গত ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভার সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের অগ্রগতি পাঠ করেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার নাঈমা জাহান সুমাইয়া। তিনি জানান, গত মাসে ১টি খুন, ১টি ডাকাতি, ৩টি ধর্ষণ, ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন, ৬টি চুরি, ১৬টি অপমৃত্যু, ২টি মানব পাচারসহ মোট ৯৮টি মামলা হয়েছে জেলার ৫টি থানায়। আইন-শৃঙ্খলা কমিটির আলোচনাসভায় সদস্যগণ জানান, চুয়াডাঙ্গায় বর্তমানে চুরি-ছিনতায় কিছুটা বেড়েছে, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার ডিজিটাল মোড়ে রাতে কিছু যুবকের আনাগোনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ডিউটিরত পুলিশদের এনড্রয়েড মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে বিরত রাখা, চৌরাস্তার মোড়, মাথাভাঙ্গার পুরাতন ব্রিজের মুখে এবং চুয়াডাঙ্গা-জীবননগর রোডের বাসগুলো চৌরাস্তার মোড়ে বাসস্ট্যান্ড কারণে যানজন সৃষ্টি হচ্ছে, ওভারব্রিজের কারণে রেলবাজার-বড়বাজার সড়কে একটা রাস্তা বন্ধ থাকায় জানজট সৃষ্টি হচ্ছে, স্টেশন রোড হয়ে কোর্ট পর্যন্ত রেল কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয় করে রাস্তার দু’ধারে যেসব ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে জায়গা দখল করেছে তার সমাধান করা, সদর হাসপাতাল এলাকায় জানজট নিরসনের উদ্যোগ নেয়া, হাসপাতাল চত্বরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকানগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া, বিশেষ করে ইজিবাইক রাখার স্থানে এখন মাইক্রোবাস ড্রাইভাররা দখল করে রেখেছে সেগুলোর সমাধান করা, শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে স্পিডব্রেকার নির্মাণ করা, পৌর শহরের সড়কগুলোতে গরু ও কুকুরের অবাধ বিচরণ যা পথচারী ও স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা এবং সাধারণ মানুষের পথচলায় অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া, মোটরসাইকেলে হ্যালোজেন লাইট ব্যবহার বেড়ে যাওয়া, জেলার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল ডিসপ্লেতে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, ছাত্রলীগ আবার ফিরবে ভয়ঙ্কর রূপে’ সংবলিত লেখা উঠছে সেগুলোর সমাধান করা, সম্প্রতি নাসিং ইন্সটিটিউটে দুর্নীতির বিষয়ে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তাদেরকে বিভিন্নভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়া গ্রাম আদালতের মামলাগুলো দীর্ঘদিন ধরে আটকে না রেখে সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া, পুলিশী প্রতিবেদনের সময়ে আইনী দিকটা ভালোভাবে দেখা ও গ্রাম আদালত সম্পর্কে আরও বেশি প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোর ব্যাপারে আলোচনা করা হয়। হাসপাতালে সমস্যাগুলোর ব্যাপারে সিভিল সার্জন ডা. হাদী জিয়াউদ্দীন বলেন, নার্সিং ইন্সটিটিউটে যে দুর্নীতির বিষয়টি আছে সেটা আমি আসার আগেই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে এবং তা চলমান আছে। আমি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি যেটা সত্য সেটা প্রতিবেদনে তুলে ধরতে হবে। আর হাসপাতাল চত্বরের দোকানসহ অন্যান্য যে বিষয়গুলো আছে সেগুলো নিয়ে আমি তত্ত্বাবধায়কের সাথে আলোচনা করে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করবো। সভায় পুলিশ সুপার খন্দকার গোলাম মওলা বলেন, এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও আমার জন্য খুবই ভালো একটা সভা অনুষ্ঠিত হলো। আলোচনার প্রথমেই ছিলো চুরি। চুরি একটু বৃদ্ধি পেয়েছে। রাতে ডিউটিরত পুলিশের এন্ড্রয়েড মোবাইল ব্যবহারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। এ ব্যাপারে বিরুপ মন্তব্যও শুনতে পাই যে, স্যার এসেই এতো কড়া হচ্ছেন। এসব আমলে না নিয়ে আমি এ ব্যাপারে আরও ভালো পদক্ষেপ নেবো। ইদানিং চুয়াডাঙ্গা শহরে একটি মোবাইল ফোনের দোকানে চুরি সংঘটিত হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে অনেক সকালের দিকে। এছাড়া প্রেসক্লাবের পেছনে অন্ধকারের মধ্যে তার চুরির ঘটনা ঘটেছে। আসলে পুলিশের অতোটা গভীরে যাওয়া উচিত না এটা বলবো না কিছু সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়। চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন মার্কেট থেকে যদি আমাদের সহযোগিতা না করা হয় সেক্ষেত্রে পেরে ওঠা কিন্তু কষ্ট হয়ে যায়। মনে করেন অনেক সময় পুলিশ গাড়ি নিয়ে ডিউটিতে গেলো এমন জায়গায় গাড়ি নাও ঢুকতে পারে। অনেক সময় ধারণাও করা যায় না এখানে চুরি হতে পারে। আমাদের শহরের বিভিন্ন এলাকায় নাইটগার্ড বাড়ানো উচিত। আর যারা টহলে থাকে তাদেরকে আমি বার বার বলি এটা আরও জোরদার করা হবে। সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে শুধু জিজ্ঞাসাবাদ না ছবি তুলেও রাখবেন। পরবর্তীতে হয়তো কোনো ঘটনা ঘটছে আমাদের কোনো কাজে লাগতে পারে। কিশোর গ্যাং নির্মুলে আমরা তৎপর আছি। আপনাদের কাছে যদি কোনো তথ্য থাকে নাম, ঠিকানা দিয়ে আমাকে এসএমএস করবেন আমি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেব। সম্প্রতি আমার কাছে অনেক এসএমএস এসেছে ডুগডুগি এলাকায় জুয়ার ব্যাপারে। এ ব্যাপারে অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানকালে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সকলে পালিয়ে গেছে। আর নিভৃতে চাঁদাবাজির বিষয়ে কোনো অভিযোগ না পেলে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। এ ব্যাপারে আপনাদের সহযোগিতা দরকার বলে আমি মনে করি। যারা এর শিকার হয়েছেন তারা যেনো আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। আর চৌরাস্তার মোড়ে যানজট নিরসনে আমার উদ্যোগে বাস মালিকদের বলেছিলাম বাসগুলো ওখান থেকে যাত্রী ওঠানামা যেনো না করে। উনারা আমার কথায় রাজি হলো। ৭দিন পর আবার একই অবস্থা। উনারা জানালেন কালীগঞ্জ রুটের গাড়ির মালিকরা আপত্তি জানিয়েছেন ওখান থেকে যদি যাত্রী ওঠানামা না করে তাহলে তারা গাড়ী বন্ধ করে দেবে। এখন এ চ্যালেঞ্জ কে নেবে? হাসান চত্বর নিয়ে আমাকে নানান কথা শুনতে হয়। আসলে আমিও চাই হাসান চত্বর যানজটমুক্ত হোক। আমরা সামগ্রিকভাবে বসে এ ব্যাপারে সমাধানের চেষ্টা করবো। তাছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরে যানজট নিরসনে অটোরিকশা চলাচলের বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া মোটরসাইকেলে লাইট ব্যবহার। আসলে আমরা ধীরে ধীরে সবকিছুই করার চেষ্টা করছি। বর্তমানে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদের পুরোপুরি হেলমেট ব্যবহারে সচেতনতা নিয়ে কাজ চলছে। ইনশাআল্লাহ ধীরে ধীরে সবকিছুর ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নেবো। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক আরও বলেন, আসলে আমরা এখানে বসে বিগত এক মাসের জেলার আইন-শৃঙ্খলা বিশেষ করে পুলিশ-বিজিবি, এনএসআই, ডিজিএফআই, প্রশাসন সকলেই তো আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে কাজ করে থাকি। একটা বিষয় বিশেষ করে বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন থামানো নিয়ে যে ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে আমি খুব টেনশনে থাকি। মনে করেন এখানে তো ২-৩শ’ লোকের সমাগম হয়। আসলে আন্দোলনকারীদের মধ্যে কে কী উদ্দেশ্য নিয়ে আসে সেটা তো বোঝা যায় না। দামুড়হুদা জয়রামপুরে স্টেশনে সাড়ে ৫টায় ট্রেন আসবে। কিন্তু তখন তো প্রায় সন্ধ্যা। আসলে সবাই যে ভালো মন মনসিকতা নিয়ে জড়ো হবে তা কিন্তু না। এখানে যারা উপস্থিত আছেন সকলে সচেতন মানুষ। আপনারা বিভিন্ন জায়গায় ম্যাসেজটা দিয়েন। আসলে সচিব স্যার আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘এভাবে প্রত্যেকটা স্টেশনে যদি ট্রেন থামে তাহলে তো ইন্টারসিটি থাকে না।’ আসলে এই কথাগুলো তো আন্দোলনকারীদের সামনে বলা যায় না। তারা আসছেই তো ট্রেন স্টেশনে থামানোর দাবি নিয়ে। আসলে এগুলো জাতীয় সমস্যা। আসলে সকলকে ভাবতে হবে ট্রেনের যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টা। এগুলো সকলেরই মাথায় থাকা উচিত। আসলে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন সকলেরই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত। এছাড়া জেলার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, সরকারি প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল ডিসপ্লেতে বিভিন্ন ধরণের লেখা উঠছে। আসলে আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি। একটা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ডিসপ্লে নিয়ন্ত্রণ করতে একটা পাসওয়ার্ড লাগে। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা অনেক বছর আগে এগুলো চালু করে দিয়ে পার্সওয়ার্ড হয়তো তারা প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে গেছে এবং বলে গেছে পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে নিয়েন। দেখা গেছে তাদের সেট করে দেয়া পাসওয়ার্ডই প্রতিষ্ঠানের কারো মনে নেই। তো সেক্ষেত্রে আমি মনে করি এগুলো যদি হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে চলে আমাদের নিয়ন্ত্রণে যদি না থাকে তাহলে এগুলো বন্ধ করে রাখা উচিত। আর শহরের রাস্তাগুলোতে গরু ও কুকুরের অবাধ বিচরণের যে বিষয়টি সেগুলো পৌরসভার মাধ্যমে মাইকিং করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নয়ন কুমার রাজবংশী, সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ইকরামুল হক, সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক আহসান আলী, আনসার ও ভিডিপির জেলা কমান্ড্যান্ট ফারুক ইসলাম, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দীপক কুমার পাল, বিজিবি-৬ ব্যাটালিয়নের সহকারী পরিচালক হায়দার আলী, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম. সাইফুল্লাহ, আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মেহেদী ইসলাম, দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ মহল, জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-আমীন, এনএসআই’র উপ-পরিচালক শামসুল হক, জেলা শিক্ষা অফিসার দিল আরা চৌধুরী, সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রমোশন অফিসার ছানোয়ার হোসেন, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাকসুরা জান্নাত, ডেপুটি জেলার লিমা খাতুন, পাবলিক প্রসিকিউটর মারুফ সারোয়ার বাবু, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাঈদ মাহমুদ শামীম রেজা ডালিম, প্রেসক্লাব সভাপতি রাজীব হাসান কচি, সাধারণ সম্পাদক বিপুল আশরাফ, ডিজিএফআই প্রতিনিধি বিল্লাল হোসাইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শিরীন আক্তার, সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শারমিন সেলিনা আজহার, গ্রাম আদালত প্রকল্পের জেলা ম্যানেজার আছাদুজ্জামান, পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র কেমিস্ট নরেশ চন্দ্র বিশ্বাস প্রমুখ। পরে একই সম্মেলন কক্ষে জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, আদালত সহায়তা, সন্ত্রাস ও নাশকতা প্রতিরোধ; মানব পাচার প্রতিরোধ; চোরাচালান নিরোধ সমন্বয়; সড়ক দুর্ঘটনা হতাহতদের নির্ভুল ও সমন্বিত পরিসংখ্যান প্রণয়ন; জেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটি; চোরাচালান নিরোধ; অনিস্পন্ন চোরাচালান মামলাসমূহ সম্পর্কে মনিটরিং সেলের সভা অনুষ্ঠিত হয়।