গাংনী প্রতিনিধি: মেহেরপুর গাংনীর ইবি ছাত্রী নিশাত তাসনিম উর্মি হত্যাকা-ের অভিযোগ থেকে আসামিদের অব্যাহতি চেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। প্রতিবেদনে প্রাথমিক সুরতহাল রিপোর্টের উপস্থিতি নেই। আসামি পক্ষের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গল্প তৈরি করে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী। এ ঘটনায় মামলার বাদীসহ জনমনে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মামলার এজাহার, সুরতহাল রিপোর্ট ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে নানা গড়মিল লক্ষ্য করা গেছে। এজাহারে উল্লেখিত স্বাক্ষীদেরকে কোন প্রকার স্বাক্ষ্য নেয়া হয়নি। একটি সাদা কাগজে দুইজন স্বাক্ষীর স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ইবি ছাত্রী উর্মিকে স্বামীর বাড়িতে শারীরিক নির্যাতন ও শ^াসরোধে হত্যা করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়। উর্মির স্বামীর বসত ঘরের জানালার পর্দা টাঙানো হুকের সাথে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে তার স্বামী পক্ষের লোকজন। পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন মরদেহ উদ্ধারের পর সেই স্থানটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এমন একটি স্থানে কোনভাবেই আত্মহত্যা করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন সকলেই। মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার সময় আত্মহত্যার দাবিকৃত স্থানটি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কারও মতামত নেননি মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা গাংনী থানার এসআই শাহীন মিয়া। জানালার সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে মর্মে স্বামী পক্ষের লোকজন প্রচার করায় স্থানীয় লোকজন তা মেনে নেয়নি। স্থানীয়রা বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে বিষয়টি হত্যাকা- বলেই জোর দাবি জানিয়েছে। এদিকে পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার সময় উর্মির স্বামী এবং উর্মি হত্যা মামলার প্রধান আসামি আশফাকুজ্জামান প্রিন্স নিজ ঘরেই ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে। প্রতিবেদনে উল্লেখিত ঘটনার এ সময়ে বাড়ির সব মানুষ ঘুমিয়ে থাকার বিষয়টিও সন্দেহজনক বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। মরদেহ উদ্ধারের পর গাংনী থানার এসআই শাহীন মিয়া সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, উর্মির গলার ডান দিকে আঙ্গুলের কালোদাগ রয়েছে। পিঠে ও কোমরে মারধর করা কালশিরা চিহ্ন বিদ্যমান। এবং শরীরের কোথাও তরল পদার্থ নির্গত হবার চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এদিকে ময়নাতদন্ত রির্পোটে সুরতহাল রিপোর্টের কোন মিল নেই। মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন মিয়া প্রতিবেদনে সুরতহাল রিপোর্টের গলার দাগের বিষয়টিও এড়িয়ে গেছেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সঠিক হয়নি মর্মে আগেই অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী। ভিসেরা রিপোর্ট তৈরির জন্য উর্মির শরীরের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড। দীর্ঘ ২২দিন সেই উপকরণ হাসপাতালে ফেলে রেখেছিলেন তারা। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ হলে টনক নড়ে মেডিকেল বোর্ডের। পরে মনগড়া একটি ময়নাতদন্ত করে আত্মহত্যা বলে প্রতিবেদন দেয় বলে অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী গোলাম কিবরিয়া। স্থানীয়দের দাবি, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন যেহেতু বিতর্কিত হয়েছে তাই পুলিশের তদন্তে উর্মির মৃত্যু রহস্য উন্মোচন হবে বলে আশা ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিবেদন আরও হতাশাজনক। তাহলে কি ভুক্তভোগী কোন মানুষ ন্যায়বিচার পাবে না ? মেধাবি একজন ছাত্রীর নির্মম মৃত্যুর সঠিক কারণ তবে কি কেউ জানতে পারবে না ? এমন নানা প্রশ্ন এখন সচেতন মহলের। উর্মির স্বামীর পরিবার ধর্নাঢ্য ও প্রভাবশালী। তাহলে কি তাদের টাকা আর ক্ষমতার কাছে কি ঘটনার আসল কারণ পাল্টে গেছে ? এমন প্রশ্ন এখন অনেকেই করছেন মামলার বাদীর কাছে।
জানা গেছে, মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উর্মিকে আত্মহত্যা বলে দাবি করেছেন মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন মিয়া। মূলত পুলিশের গোপন তদন্ত কিংবা স্বাক্ষীদের কোন বয়ানের গুরুত্ব নেই। মূলত উর্মি হত্যা মামলার প্রধান আসামি তার স্বামী প্রিন্স ও তার পিতার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য দিয়েই তিনি প্রতিবেদন সাজিয়েছেন। মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে আসামিদেরকে বাঁচানোর জন্য আসল ঘটনা আড়াল করেছেন বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।
উর্মির মরদেহ উদ্ধারের পরদিন গাংনী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ও এসআই শাহীন মিয়া বিভিন্ন মিডিয়ায় দেয়া সাক্ষাতকারে হত্যাকা- বলে সন্দেহের কথা বলেছিলেন। এর স্বপক্ষে তারা উর্মির শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের দাগের কথাও উল্লেখ করেন। বিশেষ করে গলায় আঙ্গুলের ছাপ থাকার বিষয়টি তারা গলাটিপে হত্যাকা-ের দিকে ইঙ্গিত বহন করছে বলে জানান। তাছাড়া যৌতুকের কারণে যে উর্মিকে প্রায়ই নির্যাতন করা হতো তার প্রমাণ পাওয়ার কথাও বলেছিলেন তারা। অপরদিকে প্রিন্সের পরিবার আত্মহত্যা বলে দাবি করলেও আত্মহত্যার স্থানটি নিয়ে জোরালো সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন এসআই শাহীন মিয়া। অথচ চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা দাবিকৃত স্থানটি সম্পর্ক তিনি কোন নির্দিষ্ট যুক্তি দাড় করাতে পারেননি। অন্যদিকে যৌতুকের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। এর পেছনে আসল রহস্য কি ? এমন প্রশ্ন এখন গাংনীর মানুষর মুখে মুখে।
জানা গেছে, নিহত উর্মির পিতা গোলাম কিবরিয়া যৌতুকের নগদ টাকা দিতে না পেরে উর্মির নামে এক বিঘা জমি রেজিস্ট্রি করে দেন ২০১৯ সালে। যার দলিল প্রিন্সের কাছেই ছিলো। এই জমি বিক্রি করে স্বামী প্রিন্স প্রাইভেট কার কেনার জন্য স্ত্রী উর্মির ওপর নির্যাতন করে আসছিল। পরে প্রিন্সের পিতা তাকে প্রাইভেট কার কিনে দেয়। এ নিয়ে প্রিন্স ও তার বাবা মায়ের রোষানলে পড়ে উর্মি। এর যের ধরেই মূলত প্রায় প্রতিদিনই নির্যাতন সইতে হতো উর্মিকে। মামলার এজাহারে বাদী গোলাম কিবরিয়া দলিলটি প্রিন্সের বাড়িতে থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অথচ তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন মিয়া দলিলের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শাহীন জানান, মামলার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেন ও বিবাদী এবং স্বাক্ষীদের জবানবন্দী নেয়া হয়েছে। চার্জশীটেসব কিছু উল্লেখ করা হয়েছে। ফাইনাল চার্জশীট প্রদান ও উর্মীর আত্মহত্যা প্ররোচনাকারী হিসেবে তার স্বামীকে দেখিয়ে আদালতে ফাইনাল প্রতিবেদন দাখিলের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। তদন্তে কোন অনিয়ম করা হয়নি।