কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ স্থাপন প্রকল্পে দুর্নীতি : জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

১০ বছরে বাস্তবায়ন ৬৩ শতাংশ আর্থিক অগ্রগতি ৪২ শতাংশ : নতুন মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচ

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: ফের আলোচনায় বহুল সমালোচিত কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্প। নতুন করে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবে শুরু হয়েছে এই আলোচনা। প্রকল্পটিতে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি এবং বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার পেছনে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা এবং আইএমইডির তদন্তে সুপারিশের প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিরক্তি প্রকাশ করেছে প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটি। জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা দ্রুত জানাতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন করে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব ভেটোর মুখে নাকচ করা হয়েছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিআইসি) সভা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। ওই সভায় জানানো হয়, ১০ বছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে ৬৩ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৪২ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, দায়ীদের শাস্তির বিষয়টি আমি বলতে পারব না। তবে আগামী ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হবে কি না এটা এখনও বলা যাচ্ছে না। ঠিকাদার যদি একান্ত প্রচেষ্টা চালায় তাহলেই হয়তো সম্ভব। এক বছর মেয়াদ বাড়ালে হয়তে ভালো হতো। কেননা প্রকল্পটিতে এখনো অনেক বিষয়ে জটিলতা আছে।
সূত্র জানায়, পরতে পরতে অনিয়ম হয়েছে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পে। সর্বশেষ গত বছরের ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় গঠিত আইএমইডির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এমন চিত্র। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ, দরপত্র প্রক্রিয়ায় আর্থিক ও পরিকল্পনা শৃঙ্খলার বিচ্যুতি আছে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই ইচ্ছমতো প্লিন্থ এরিয়া পরিবর্তন করা হয়েছে। আর্থিক ও পরিকল্পনা শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করে নির্মাণ কাজ পরিবর্তনসহ নানা অনিয়ম ঘটে প্রকল্পটিতে। সেই সঙ্গে এর কাজে তৈরি হয় দীর্ঘসূত্রতা। তবে বিভিন্ন সময় বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরে সুপারিশ দেওয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে আইএমইডির তৎকালীন সচিব ও তদন্ত কমিটির প্রধান প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বৃহস্পতিবার বলেন, ২০১২ সালে যখন প্রকল্পটি অনুমোদন হয় তখন ২০০৮ সালের রেট সিডিউল অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল। এটা ছিল প্রকল্পের অনেক ভুলের মধ্যে অন্যতম ভুল। এসব কারণে পরবর্তী সময়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। আমরা এ বিষয়ে তদন্ত করেছি। অনিয়মের প্রমাণও পেয়েছি। প্রতিবেদন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তাগাদা দেওয়া হলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানানো হয়নি। আমি দায়িত্ব থাকার সময় পর্যন্ত কোনো আপডেট দেয়নি তারা।
স্টিয়ারিং কমিটি সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটি দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাব গত বছরের ৫ জানুয়ারি একনেকে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু তা অনুমোদন না করে বিলম্বের কারণ এবং দায়দায়িত্ব নিরূপণের জন্য তদন্ত করতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর তদন্ত করে গত বছরের ১ জুন প্রতিবেদন জমা দেয় আইএমইডির নেতৃত্বে গঠিত কমিটি। পরে একই মাসের ২১ তারিখ তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়। ওই বছরের ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত একনেক বৈঠকে প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। এ সময় আবারও ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত করলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোনো তথ্য জানায়নি। এ অবস্থায় গত ১৩ ডিসেম্বর পুনরায় তাগিদ দেওয়া হয়। এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) স্টিয়ারিং কমিটির সভায় জানান, এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর বেশি কিছু বলেননি তিনি। ব্যবস্থা গ্রহণ সংক্রান্ত তথ্য জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে পাঠানোর জন্য সভা থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ফের তাগিদ দেওয়া হয়।
প্রকল্পটির বর্তমান আর্থিক সংকটের প্রেক্ষাপটে ‘বি’ শ্রেণিতে রাখায় এর মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক। কিন্তু মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবে স্টিয়ারিং কমিটির সভায় পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের প্রতিনিধি ভেটো দেন। এ সময় তিনি বলেন, প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুনে সমাপ্ত হওয়ার জন্য নির্ধারিত ছিল। ইতোমধ্যেই ১০ বছর ধরে চলছে। তাই ফের মেয়াদ বৃদ্ধি করা ঠিক হবে না। নির্ধারিত মেয়াদে বাস্তবায়ন শেষ করতে সঠিক পরিকল্পনা দরকার। এছাড়া পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রতিনিধিও ভেটো দেন।
সূত্র জানায়, মূল প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে হওয়ার কথা। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৭৫ কোটি ৪৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা। ২০১২ সালের জানুয়ারি হতে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু যথাসময়ে কাজ শেষ হয়নি। এরপর দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবের মাধ্যমে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়। এ সময় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮২ কোটি ৪৬ লাখ টাকায়।

Comments (0)
Add Comment