অবৈধভাবে মজুদ করা ৮৩ বোতল নাফা উদ্ধার শেষে ধ্বংস

জীবননগরে ইনতেফা কোম্পানির বিরুদ্ধে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ

নারায়ণ ভৌমিক: বালাইনাশক ইনতেফা কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনবিহীন ও সরকার নিষিদ্ধ তরল সার নাফা ধ্বংস করা হয়েছে। গত সোমবার অবৈধভাবে মজুদ করা ৮৩ বোতল নাফা উদ্ধার ও জব্দ করে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলা পরিষদ চত্বরে প্রকাশ্যে ধ্বংস করা হয়। জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার এ সাহসী পদক্ষেপ ও বিচক্ষণতায় কোম্পানির ভূয়া রেজিস্ট্রেশনকৃত এ অবৈধ পণ্যটি চিহিৃত করায় তাকে অনেকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

জানা গেছে, জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার অভিযোগ পেয়ে দেশের খ্যাতনামা বালাইনাশক ইনতেফা কোম্পানির নাফা পণ্যের রেজিস্ট্রেশন সনদ দাখিল করার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। গত ১৩ মার্চ চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলার ইনতেফা কোম্পানীর জীবননগর প্রতিনিধিকে গত ১৩ মার্চ ১১১ নং স্মারকে এ নোটিশ দেয়া হয়। পত্রটি সদয় অবগতির জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চুয়াডাঙ্গা জেলা সার বীজ মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব উপ-পরিচালককে এর অনুলিপি প্রেরণ করা হয়।

প্রেরিত নোটিশ সূত্রে জানা গেছে, ইনতেফা কোম্পানির নাফা নামক পিজিআর যার রেজি. নং: আইএমপি-৩৩৩’র রেজিস্টেশন সনদ অদ্য হতে ৩ (তিন) কর্ম দিবসের মধ্যে অত্র দপ্তরে দাখিল পূর্বক ব্যবসায়ী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো। ৩ (তিন) কার্যদিবস অতিবাহিত হলে ইনতেফা কোম্পানির জীবননগর প্রতিনিধি হালনাগাদ কোনো রেজি. সনদ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করতে পারেনি। কোম্পানির আঞ্চলিক কর্মকর্তা নাজমুল হক দায়সারা লিখিত দিয়ে পণ্যটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ অঙ্গীকারনামা পেয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকতা শারমিন আক্তার বিব্রত হয়ে কোম্পানি প্রতিনিধিকে এ ধরনের রেজিঃবিহীন পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার ও সর্তক করেছেন। এ সর্তক বার্তা পেয়ে গত সোমবার বাজার থেকে ৮৩ বোতল সরকার নিষিদ্ধ নাফা তরল সার উদ্ধার করে কৃষি অফিসে জমা দেয়া হয়। কৃষি কর্মকর্তা তা জব্দ করে প্রকাশ্যে উপজেলা পরিষদ চত্বরে ধ্বংস করেছে। তাহলে কৃষকদের ব্যবহৃত পণ্যটি কি সরকার নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকারক? জনমনে এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তথ্য ও অনুসন্ধান নিয়ে দেখা গেছে, ইনতেফা কোম্পানীর সর্বশেষে ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী সার ও কীটনাশকসহ ৭৪টি পণ্য তালিকায় নাফা নামের কোনো পণ্যের নাম নেই। কিন্তু কোম্পানী প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশের প্রায় ৮ হাজার ডিলারের মাধ্যমে নাফা নামক পণ্যটি সরবরাহ করে বাজারজাত করে আসছে। যার রেজিঃ নং  লেখা হয়েছে আইএমপি ৩৩৩। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানান, ভূয়া রেজিঃ নং দেখিয়ে এই পণ্যটি বিক্রিতে সংশ্লিষ্ট ডিলারদের দেয়া হয় লোভনীয় আফার। দেখা যাক কোম্পানীর রিটেইলারে কি লোভনীয় অফার রয়েছে। গত ২০১৪-১৫ সালের রিটেইলার সেলস প্রোগ্রাম তালিকায় বাৎসরিক এক লাখ টাকা বিক্রিতে ১টি ফ্রাইপেন (কিয়ামব্রান্ড/ কোম্পানীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১ লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা বিক্রিতে ১টি ফ্যান/ (কোম্পানীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী), ২ লাখ টাকায় ১.৫ লিটার ব্লেন্ডার মেশিন (কোম্পানীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী), ৩ লাখ টাকা বিক্রি দেখালে একটি পেডিস্ট্যাল ফ্যান (মিরা ব্রান্ড অথবা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক), ৪ লাখ টাকা বিক্রি দেখালে (একটি মোবাইল সেট কোম্পানীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী), ৫ লাখ টাকা বিক্রি দেখালে ড্রেসিং টেবিল মডেল নং ডিটিএইচ (রিগ্যাল ব্রান্ড/ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক), ৬ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারলে কক্সবাজার ভ্রমণ ২ রাত ৩ দিন (সড়কপথে), ৭ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারলে ১৪ ইঞ্চি রঙ্গিন টিভি (ওয়ালটন/ কোম্পানীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী), ৮ লাখ টাকা বিক্রি দেখালে ওয়্যারড্রোব মডেল নং সিডিএইচ-১০১ (রিগ্যাল ব্রান্ড/কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক), ৯ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারলে বান্দরবান ও কক্সবাজার ভ্রমণ ৩ রাত ৪ দিন (সড়কপথে), ১০ লাখ টাকা বিক্রি দেখালে ২১ ইঞ্চি রঙ্গিন টিভি (ওয়ালটন/ কোম্পানীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী), ১২ লাখ টাকা বিক্রি দেখালে ডাবল বেডের খাট মডেল নং বিডিএইচ-১০৩ (রিগ্যাল ব্রান্ড/ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক), ১৫ লাখ টাকা বিক্রি দেখালে ডাইনিং টেবিল ও চেয়ার মডেল নং টিডিএইচ+সিএফডি-২০১ (রিগ্যাল ব্রান্ড/ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক), ২০ লাখ টাকা বিক্রি করলে তাকে দেয়া হবে ১০ সিএফটি রেফ্রিজারেটর (ওয়ালটোন/ কোম্পানীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী) ২৫ লাখ টাকা যে বিক্রি করতে পারবে তাকে কাঠমন্ডু, নেপাল ২ রাত ৪দিন (আকাশ পথে), ৩০ লাখ টাকা বিক্রি দেখালে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে থিম্পু, ভুটান ভ্রমণ ২ রাত ৩দিন (আকাশ পথে)। প্রশ্ন উঠেছে ডিলারদের এত লোভনীয় আফার কোনো? তথ্য অনুসন্ধান নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৭ জুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. আব্দুল কাইয়ূম চৌধুরী স্বাক্ষরিত পত্রে দেশে তরল সার ব্যবহার ও আমদানী না করার জন্য নীতিমালা প্রনয়ণ করে কোম্পানী ও আমদানীকারকদের পত্র প্রেরণের মাধ্যমে অনুরোধ করা হয়। যার কৃষি মন্ত্রণালয়ের স্বারক নং ১২০২৬০৪০০০০০০০৪,২০১০ (অংশ-১)-৯৭ তারিখ ৫ মে ২০১৩। যার অনুলিপি ঢাকা খামারবাড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও দেশের সব বালাইনাশক কোম্পানীকে দেয়া হয়। সূত্র জানান, ইনতেফা কোম্পানীর নাফা তরল সার ফসল, মাটি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সরকারি সিদ্ধান্ত অমান্য করে বালাইনাশক ইনতেফা কোম্পানী ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী সার ও কীটনাশকসহ ৭৪টি পণ্যের মধ্যে নিষিদ্ধ ক্ষতিকারক নাফা তরল সার ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ মিলি ও ১ লিটার বোতলজাত করে ও ভূয়া রেজি. নং দেখিয়ে সারাদেশে প্রায় ৮ হাজার ডিলারের মাধ্যমে পণ্যটি ১০ বছর দেদারচ্ছে বিক্রি করা হয়েছে। অবৈধ পথে এই পণ্যটি আমদানী করে কোম্পানী সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে প্রায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ ব্যাপারে ইনতেফা কোম্পানীর যশোর, কুষ্টিয়া, মাগুরা, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গাসহ ৯টি জেলার এরিয়া ম্যানেজার শহিদুল ইসলামের সাথে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি মাথাভাঙ্গাকে বলেন, আমার এলাকায় ১৬৪ জন ডিলার রয়েছে। ইনতেফা কোম্পানী ডিলারদের চাহিদা অনুয়ায়ী উদপাদিত পণ্য সরবরাহ ও বাজারজাত করা হয়ে থাকে। নাফা’র রেজিস্ট্রেশন সনদ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ভূয়া রেজিস্ট্রেশন নং ব্যবহার সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ প্রসঙ্গে আমি এর বেশী কিছু বলতে পারবো না। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার মাথাভাঙ্গাকে সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, অভিযোগ পেয়ে কোম্পানীর উপজেলা প্রতিনিধিকে রেজিস্ট্রেশনের কাগজপত্র দাখিল করার নোটিশ দেয়া হয়। তিনি হালনাগাদ কোনো রেজিস্ট্রেশন নাই ও পণ্যটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার লিখিত আবেদন জমা দিয়েছেন। এ অবৈধ নাফা পণ্যটি গত সোমবার বাজার থেকে ৮৩টি বোতল জব্দ করে প্রকাশ্যে ধ্বংস করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, যদি কোনো ডিলার বিক্রির জন্য ক্রয়, মজুদ, বাজারজাত ও কৃষকদের নিকট সরবরাহ করার কোনো তথ্য পাওয়া গেলে সেখানে অভিযান পরিচালনা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

Comments (0)
Add Comment