হারুন রাজু/হানিফ মল্ডল: মানুষ বেঁচে থাকে তার সৃষ্টি ও কর্মের মধ্য দিয়ে। সততা, নিষ্ঠা, দুরদর্শিতা ও আন্তরিকতার মাধ্যমে স্থান করে নেয় মানুষের হৃদয়ে। যাদের প্রজ্ঞা ও স্পর্শে প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি ফিরে পায় প্রাণ, মানুষকে বেধে রাখে ভালোবাসার বাঁধনে তাদের মধ্যেই একজন দর্শনার কৃতিসন্তান শেখ শাহাব উদ্দিন। যাকে বাদ দিলে কেরু এ্যান্ড কোম্পানীর ইতিহাস থেকে যাবে অসম্পন্ন, যিনি জীবনের ৩০ বছর নিজ কর্মে দক্ষতা, দায়িত্ববোধ ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করে সততার স্বাক্ষর রেখেছেন। যিনি একজন সমাজসেবক, ক্রিড়া অনুরাগী, সাংস্কৃতিমনা ও ধর্মভিরু ব্যক্তিত্ব; তিনিই হলেন সকলের প্রিয় শেখ শাহাব উদ্দিন। যে মানুষটার দপ্তরে গিয়ে কেউ নিরাস হয়নি, সকলেই ফিরেছে হাসি মুখে সে মানুষটাই সরকারের বিধি মোতাবেক অবশেষে অবসর গ্রহণ করলেন এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি, ঐতিহ্যবাহি ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান কেরুজ চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) পদ থেকে। যার অবসরে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা কষ্ট। বিদায়ের দিনে মিলের বিভিন্ন বিভাগের বিদায় সংবর্ধনুষ্ঠানেও হাসি মুখে বিদায় নিলেও কেদেছে অনেকেই। একজন শেখ শাহাব উদ্দিন। কর্মমুখি এ মানুষটি ১৯৬৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর জন্মেছেন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার জেহালা ইউনিয়নের গড়চাপড়া গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। দাদা সখের আলী বিশ্বাসের বাড়িতে জন্মালেও ১৯৬৮ সালে কেরুজ চিনিকলে বাবার চাকরির সুবাধে দর্শনায় আসেন স্বপরিবারে। শেখ শাহাব উদ্দিনের বাবা শওকত আলী ছিলেন চিনিকলের গোপনীয় শাখায় কর্মরত। শেখ শাহাব উদ্দিন প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন অর্ঘনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৮০ সালে কেরুজ উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি পাস করে দর্শনা সরকারি কলেজে পড়েছেন এইচএসসি পর্যন্ত। পরে তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জনে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি অনার্স ও মাস্টার সম্পন্ন করেন। ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর কেরুজ চিনিকলের জেনারেল অফিসে কনিষ্ঠ করনীক পদে যোগদান করেন। কর্মদক্ষতা, দুরদর্শিতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকায় ১৯৯৪ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি প্রথম পদন্নতি পেয়ে দায়িত্ব পালন করেন জ্যেষ্ঠ করনীক পদে। ১৯৯৯ সালের ২৩ আগস্ট ফের পদন্নতি পেয়ে প্রশাসন বিভাগের গোপন শাখার গোপনীয় সহকারী পদে যোগদান করেন। ২০০৩ সালের ১৮ অক্টোবর সহকারী সমন্বয় কর্মকর্তা পদে পদন্নতি পান। ২০০৮ সালে ৩০ জুন ডিস্টিলারী সেলসের জুনিয়ার অফিসার, ওই বছরেরই ২২ ডিসেম্বর একই বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক পদে পদন্নতি পান। ২০১১ সালে বদলি জনিত কারণে তিনি রংপুর চিনিকলে বাণিজ্যিক বিভাগের সহব্যবস্থাপক পদে যোগদান করেন। মাত্র ৪ মাসের মাথায় ২০১১ সালের ১১ জুন রংপুর থেকে বদলি হয়ে প্রাণের প্রতিষ্ঠান কেরুজ চিনিকলে ফিরে আসেন। ডিস্টিলারি বিভাগের সেলস সহব্যবস্থাপক পদে যোগদান করেন। ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল বাণিজ্যিক বিভাগের উপ-ব্যবস্থাপক পদে পান পদন্নতি। ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি প্রশাসন বিভাগের উপ-ব্যবস্থাপক পদে পদন্নতি পান। এ সময় তিনি ডিস্টিলারি বিভাগের উপ-ব্যবস্থাপক হিসেবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পান। ফলে মিষ্টভাষি শেখ শাহাব উদ্দিন ২০২১ সালের ৪ মার্চ কেরুজ চিনিকলের অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রশাসন বিভাগের (ভারপ্রাপ্ত) মহাব্যবস্থাপক পদে চাকরীর শেষ দিন অর্থাৎ গতকাল ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। শেখ শাহাব উদ্দিন ১৯৮৫ সালের ১ নভেম্বর বিয়ে করেন চিনিকলের তৎকালীন টাইম কিপার ইদ্রিস আলীর মেয়ে মর্জিনা খাতুনের সাথে। সংসার জীবনে তিনি ১ মেয়ে ও ২ ছেলের জনক।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশারফ হোসেন চাকরির পাশাপাশি তিনি সামাজিক, ধর্মীয় ও ক্রিড়া সংগঠনের সাথে রয়েছেন জড়িত। উল্লেখ্যযোগ্য একজন দানশীল শেখ শাহাব উদ্দিন কেরুজ বয়েজ ক্লাবের সভাপতি, আনোয়ারপুর গোরস্থান কমিটির উপদেষ্টা, দর্শনা প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা, কেরুজ প্লাটিনাম জুবলি উৎযাপন পরিষদের সভাপতিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করছেন। কেরুজ চিনিকলের যখন দুর্দিন কেটেছে তখন শেখ শাহাব উদ্দিন কর্মকর্তা-কর্মচারী, আখচাষিসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে সমন্বয় করে এগিয়ে নিয়েছেন কার্যক্রম। বেগবান করেছেন আখচাষ ও ডিস্টিলারি উৎপাদন। যে কারণে চিনিকলের অনেকের মুখে শোনা যাচ্ছে কেরুজ চিনিকলের ইতিহাস লেখা শেখ শাহাব উদ্দিনের বাদে অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।
শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি ফিরোজ আহাম্মেদ সবুজ, সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান সহসভাপতি মোতাফিুর রমহমান যুগ্মসম্পাদক খবির হোসেন অভিন্ন ভাষায় বলেন, নিরহংকার শেখ শাহাব উদ্দিনের অবদানের কথা ভুলবে না মিলের কেউ। সরকারের বিধি মোতাবেক অবসর ও বদলি বাধ্যতামূলক। তেমনি বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণ করেছেন দর্শনার পরিচিত ও প্রিয় মুখ শেখ শাহাব উদ্দিন। দর্শনা তথা চুয়াডাঙ্গাবাসীর প্রাণের সম্পদ, সরকারের মূল্যবান প্রতিষ্ঠান কেরুজ চিনিকলের বৃহত্তরে স্বার্থে এলাকাবাসী আরো একজন শেখ শাহাব উদ্দিনের মতো কাউকে দেখতে চায় চিনিকলের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের ওই চেয়ারে। এদিকে, শেখ শাহাব উদ্দীনের অবসরে দৈনিক মাথাভাঙ্গার সম্পাদক ও প্রকাশ বলেন, শেখ শাহাব উদ্দীন ছিলেন দৈনিক মাথাভাঙ্গার অকৃত্রিম বন্ধু। দৈনিক মাথাভাঙ্গার অগ্রযাত্রায় তার সহযোগিতা ভুলার নয়। তিনি যেমন মাথাভাঙ্গার সাথে ছিলেন তেমনই অবসরে নিলেও মাথাভাঙ্গার সাথেই থাকবেন। মাথাভাঙ্গাও তার সাথে থাকবে। শাহাব উদ্দীনের আগামী দিনগুলো সুস্থ ও সন্দর হোক এই কামনায় করি।