মাথাভাঙ্গা মনিটর: আফগানিস্তানে ২০ বছর ধরে চলা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে দেশটি থেকে সব সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তালেবান ফের আফগানিস্তানের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয়ায় তাড়াহুড়ো করে ও অপমানজনকভাবে দেশটি থেকে সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য হয় ওয়াশিংটন ও এর ন্যাটো মিত্ররা। স্থানীয় সময় সোমবার রাত ১২টা বাজার এক মিনিট আগে শেষ মার্কিন বিমান সব সেনাকে নিয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে উড়ে যায়। এর মধ্যদিয়ে শেষ হয় ২০ বছরের কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ। তালেবান মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছেন, কাবুল বিমানবন্দর এখন তাদের হাতে। এতোদিনে আফগানিস্তান সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন হলো। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ শেষ করে আফগানিস্তানের মাটি থেকে দেশটির শেষ সেনা চলে যাওয়ার পর গুলি ফুটিয়ে উলস্নাস করে তালেবান। মার্কিন সেনার সেন্ট্রাল কমান্ড কমান্ডার জেনারেল ফ্রাঙ্ক ম্যাকেঞ্জি এর কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি বিবৃতি দেন। সেখানে বলা হয়, ‘শেষ মার্কিন বিমান আফগানিস্তানের মাটি ছেড়েছে। এর মাধ্যমে আফগানিস্তানে আমেরিকার মিলিটারি মিশন শেষ হলো। মার্কিন নাগরিকদের দেশে ফেরানোর যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো, তারও সমাপ্তি ঘটলো।’ তিনি বলেন, ‘আজ (সোমবার) রাতের এ প্রত্যাহার শুধু সেনা প্রত্যাহারই নয়, বরং এটি প্রায় ২০ বছর ধরে চলা যুদ্ধেরও সমাপ্তি, যে যুদ্ধ আফগানিস্তানে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছিলো।’ ম্যাকেঞ্জি জানিয়েছেন, মার্কিন এবং যৌথবাহিনীর সেনা সব মিলিয়ে গত দুই সপ্তাহে অন্তত এক লাখ ২০ হাজার মানুষকে উদ্ধার করে আফগানিস্তান থেকে অন্য দেশে পাঠিয়েছে। তবে সবাইকে উদ্ধার করা যায়নি বলেও স্পষ্ট করে দিয়েছেন ম্যাকেঞ্জি। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীতে থাকা প্রতিটি সদস্য এখন আফগানিস্তানের বাইরে। শতভাগ নিশ্চিত করে এটি বলতে পারি আমি। এই প্রস্থানের সঙ্গে অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা যুক্ত আছে। যাদের সরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম, তাদের সবাইকে আনতে পারিনি আমরা। কিন্তু আমার মনে হয়, যদি আরও ১০ দিনও থাকতাম, তবুও সবাইকে নিয়ে আসতে পারতাম না আমরা।‘ ম্যাকেঞ্জির বিবৃতির কিছুক্ষণের মধ্যেই মার্কিন পররাষ্টমন্ত্রী অ্যান্টনি বিস্নংকেন আরও একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেখানে বলা হয়, দুইশর কম, কিন্তু একশর বেশি মার্কিন নাগরিককে আফগানিস্তান থেকে উদ্ধার করা যায়নি। তারা আফগানিস্তান ছাড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে মার্কিন সেনা তাদের উদ্ধার করতে পারেনি। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ব্যাপক কিন্তু বিশৃঙ্খলভাবে আকাশপথে মার্কিন নাগরিক, অন্য দেশগুলোর নাগরিক ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করার কারণে ঝুঁকিতে থাকা বহু আফগানকে সরিয়ে নেয়ার পর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বেধে দেয়া সময়ের মধ্যেই সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন করলো ওয়াশিংটন ও ন্যাটো মিত্ররা। এরপরও পশ্চিমা দেশগুলোকে সহায়তা করা ও সরিয়ে নেয়ার যোগ্য প্রায় লাখো আফগান পেছনে পড়ে আছেন। এ বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘যারা আফগানিস্তান ছাড়তে চান, তাদের নিরাপদে দেশটি ত্যাগ করতে দেয়ার জন্য তাদের দেয়ার প্রতিশ্রুতি পালনে তালেবানকে চাপে রাখবে বিশ্ব। আফগানিস্তানে ২০ বছর ধরে আমাদের সামরিক উপস্থিতির এখন অবসান হয়েছে।’ ক্ষমতায় আসার কিছু দিনের মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সব সেনা সরিয়ে নেবে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও আগেই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেয়ার কথা বলেছিলেন। গত এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহারে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময়সীমা বেধে দিয়েছিলেন। সেই ঘোষণা অনুযায়ী সেনা প্রত্যাহার শেষ করল মার্কিনিরা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে আল-কায়েদার জঙ্গি হামলার পর আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক বাহিনী অভিযান শুরু করে। অবশেষে সেই আফগান যুদ্ধের অবসান হলো। মার্কিন অভিযানে ২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত ইসলামি কট্টরপন্থি গোষ্ঠী তালেবান আবারও ক্ষমতায় ফিরেছে গত ১৫ আগস্ট। তালেবানের শাসনের ভয়ে হাজার হাজার আফগান দেশ ছেড়ে পালাতে মরিয়া হয়ে বিমানবন্দরে ভিড় করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আফগানিস্তানে তাদের সহযোগীদের সরিয়ে নেয়। কাবুল বিমানবন্দর শেষ পর্যন্ত মার্কিন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিলো। তারা বিমানবন্দর থেকে সামরিক-বেসামরিক লোকজন সরিয়ে নেয়। তবে শেষ মুহূর্তে মার্কিন সামরিক বাহিনী নিজেদের এবং আমেরিকান কূটনীতিকদের নিরাপদে কাবুলের বাইরে নিয়ে যাওয়ার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। গুলি-বাজি ফুটিয়ে তালেবানের উৎসব শেষ মার্কিন বিমান কাবুল বিমানবন্দর ছাড়তেই সেখানে ঢুকে পড়ে তালেবান যোদ্ধারা। শুরু হয় উৎসব। কাবুলজুড়েই আকাশে গুলি ছোড়ার শব্দ শোনা যায়। কাবুল বিমানবন্দরের ভেতরেও তারা শূন্যে গুলি চালিয়ে উৎসব করে। মঙ্গলবার কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘মার্কিন সেনা কাবুল বিমানবন্দর ছেড়েছে। আমাদের দেশ এতোদিনে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেলো।’ কাবুলে বিমান, অস্ত্র অকেজো করে রেখে গেলো মার্কিন বাহিনী এদিকে কাবুল বিমানবন্দর ছাড়ার আগে সেখানে থাকা এয়ারক্রাফট, সাঁজোয়া যান ও উচ্চপ্রযুক্তির রকেট ডিফেন্স সিস্টেম অকার্যকর করে রেখে যাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। মিশন কমান্ডার জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি জানান, মার্কিন সেনারা কাবুল বিমানবন্দরে রয়ে যাওয়া ৭৩ এয়ারক্রাফট, ৭০টি সাঁজোয়া যান এবং ২৭টি হামভি গাড়ি ‘অকার্যকর’ করে রেখে গেছে। তালেবান যেন এগুলো ব্যবহার করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতেই এমনটি করা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। ম্যাকেঞ্জি বলেন, ‘ওইসব এয়ারক্রাফট আর কখনোই ওড়ানো যাবে না। কেউ কখনোই সেগুলো চালাতে পারবে না।’ মার্কিন সেনারা বিমানবন্দরটিতে মোতায়েন করা উচ্চপ্রযুক্তির রকেট ডিফেন্স (সি-আরএএম) সিস্টেমও অকার্যকর করে রেখে গেছে। এই সি-আরএএম সিস্টেম সোমবার কাবুল বিমানবন্দরে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) রকেট হামলা প্রতিরোধ করতে ব্যবহৃত হয়েছিলো। এর আগে তালেবান যোদ্ধাদের যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বিভিন্ন সামরিক যান ও অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ওইসব সামরিক যান ও অস্ত্র আফগান সামরিক বাহিনীকে সরবরাহ করেছিলো ওয়াশিংটন। কিন্তু ওই বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করার পর তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো তালেবান যোদ্ধাদের হাতে চলে যায়।