মোঃ আব্দুর রশীদ
সংস্কৃতি বলতে সাধারণত বোঝানো হয় বিশেষ সমাজের সাহিত্য, মানুষের আচার-আচরণ সঙ্গীত, ললিত কলা, ক্রীড়া, মানবিকতা, জ্ঞানের উৎকর্ষ ও আরো অনেক শান্তি ও সৌন্দর্যের সমাহার। বহু শতাব্দীর ঐতিহ্যকে ধারণ করে গড়ে উঠেছে সংস্কৃতি। বলা হয়ে থাকে, জীবিকা সম্পৃক্ত জীবনের সার্বক্ষণিক ও বহুধা অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি। এছাড়া স্থান, কাল, পাত্র এবং গোষ্ঠীগত চেতনাও সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। এককথায়, মানুষের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত সকল কিছুই সংস্কৃতির অঙ্গীভূত। বঙ্গ ভূখণ্ডের অধিবাসীরা তাদের চিৎপ্রকর্ষ এবং ব্যবহারিক প্রয়োজনে যা কিছু উদ্ভাবন করেছে সেগুলোকে ধারণ করেই গড়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতি। অঞ্চলভেদে লোকজ সংস্কৃতির কিছুটা তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। তবে কোনো একটি ভৌগলিক অঞ্চলের সংস্কৃতির সাথে সংস্কার বিশেষ যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায়। আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস এটাই বলে নিরক্ষর কিংবা অলিখিত মানুষই সংস্কারে বিশ্বাস করেÑ কিন্তু এ-ধারণা কিন্তু যথার্থ নয়। ধরে নিলাম আপনি আধুনিক মনন-সম্পন্ন, উচ্চ-শিক্ষিত, বড় পণ্ডিত; আপনি ভুত-পেতœী-আত্মাতে বিশ্বাস বা ভয় করেন না। মনে করুন- গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন যদি গ্রামের কোনো এক শ্মশানের পথের ধারে, মাঝরাতে জনশূন্য বাঁশবাগানে, ঘুটমুটে অন্ধকার-টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে আপনাকে নিয়ে গিয়ে বলা হয়Ñ ‘এখানে গতকাল একটি মেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিলো, আপনি এখানে দাঁড়ান, কোথাও যাবেন না, আমি আসছি’Ñ আচ্ছা বলুন তো আপনার কি একবারও মনে হবেÑ কোনো অশীরি আপনার আশপাশে আছে কিংবা আপনাকে অনুসরণ করছে? অথবা যে মেয়েটি গতকাল মারা গিয়েছিলো তার কথা মনে করে শরীর ছমছম করবে না! অজ্ঞানতা অনেক সংস্কার কিংবা লোকাচারের মূল ঠিকই; কিন্তু সব সংস্কার বা লোকাচারের মূল নয়। আসলে ডিজিটাল যুগে মানুষ তথ্যপ্রযুক্তিতে যতোই উন্নতি করুক না কেনÑ এমন কিছু বিষয়-বিশ্বাস-ব্যাপার- লোকাচার-লোকসংস্কার আছে সেক্ষেত্রে মানুষ বড়ই অসহায়, অনিশ্চিয়তার শিকার। অনিশ্চয়তাবোধ থেকেও মানুষ সংস্কারে বিশ্বাস করে। বস্তুত লোকসংস্কার এবং লোকাচারগুলো মানুষের আজন্মলব্ধ প্রত্যয় ও বিশ্বাসের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
লোকসংস্কার বা লোকাচারের ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য বিচারে না গিয়ে আমরা বলতে পারি, নানাবিধ সংস্কার এবং লোকাচারে চুয়াডাঙ্গা জেলা উজ্জ্বল হয়ে আছে। এ-সব আচার-অনুষ্ঠান মূলত লৌকিক সমাজকেন্দ্রিক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পূজা-পার্বন ও উৎসব-অনুষ্ঠানে এই ‘রঙ্গেভরা বঙ্গদেশের’ অংশ হিসেবেও ঐতিহ্যবাহী-ঐতিহাসিক চুয়াডাঙ্গা জেলাও ধারণ করে আছে লোকসংস্কার ও লোকাচার। মূলত বহুসংখ্যক-বিচিত্র ধরনের অনুষ্ঠান বোঝাতে অনেকদিন ধরেই প্রচলিত হয়ে আসছে ‘বার মাসে তের পার্বন’ কথাটি। প্রকৃতপক্ষে তিথি, মাস বা ঋতুভিত্তিক লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানের সংখ্যা অনেক। এ-জনপদের প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক যুগের জাতিগোষ্ঠীর লৌকিক ও অলৌকিক বিশ্বাস-সংস্কার, ধ্যান-ধারণাকে আশ্রয় করে নানা প্রথা-পার্বন আচার-উৎসব গড়ে উঠেছে।
ধর্ম তথা শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ মানুষের আচরিত সাংস্কৃতিক জীবনের প্রায় পঞ্চাশভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। কখনো বিশ্বাসরূপে, কখনো সংস্কাররূপে, কখনো ঘরোয়া ও সামাজিক আচার-আচরণরূপে, কখনো আবার ন্যায়-অন্যায় চেতনা ও দায়িত্ববোধরূপে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কার সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য, ধর্মীয়-আচার এবং লোকাচারের মধ্যে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। ধর্মীয় আচার মূলত পারত্রিক অর্থাৎ ইহজীবনের অতিরিক্ত কোনো সত্য বা লক্ষ্যের দিকে পৌঁছানো কিংবা ইহজীবনে পাপ-পূণ্যজ্ঞান, পরজীবনে মুক্তিই ধর্মীয় আচারের প্রার্থিত। অন্যদিকে লোকাচার মূলত ইহলৌকিক অর্থাৎ বাস্তবজীবনে কিসে সমস্যা দূর হয়, ভালো-মন্দ বিষয়ক চিন্তার প্রকাশ, কোন বস্তু বা ঘটনা শুভদায়ক বা অমঙ্গলজনক প্রভৃতি। অন্যভাবে বলা যায়, প্রার্থিত লাভের অনুকূল-প্রতিকূল চিন্তার টুকরো টুকরো বিশ্বাসের সমষ্টিই লোকাচার।
তবে একটি কথা বলা যায়, লোকাচারের পেছনে জাতিগত-অবস্থানগত-পরিবেশগত মনস্তত্ব ক্রিয়াশীল থাকে। লোকাচারের মধ্যে বাস্তব কার্য-কারণ সম্পর্ক না থাকলেও মানুষ শুধু বিশ্বাস এবং মঙ্গল-অমঙ্গল, লাভ-ক্ষতির কথা ভেবে তা পালন করে থাকে। লোকাচারে কল্যাণ-অকল্যাণ বা মঙ্গল-অমঙ্গল চিন্তা যতোটা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ততোটা গোষ্ঠীগত নয়। এ-জাতীয় আচার-অনুষ্ঠানের সন্ধান চুয়াডাঙ্গা জেলায় একাধিক পাওয়া যায়। এ-সব লোকাচারকে বিভিন্ন শিরোনামে বিভক্ত করা যায়:
মানুষ বিষয়ক লোকাচার: সুন্দর শিশুদের কপালের এক পাশে কালির আঁচড় না কাটলে নজর লাগা, মানুষের ছায়া মাড়িয়ে না যাওয়া ভালো, সন্ধ্যার পরে মেয়েদের খোলাচুলে থাকা অলক্ষণ, হাত থেকে বাসনকোসন পড়ে গেলে অতিথি আসার সম্ভাবনা, দুজনের মাথায় ঠুকে গেলে- আবার দুজনে ইচ্ছেকৃত না ঠুকলে শিং গজানোর সম্ভাবনা, কোনো প্রসূতি নারী গর্ভাবস্থায় বাঁদর দেখলে সন্তান বাঁদরের মতো চঞ্চল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে বিশ্বাস, গায়ে পাখা লাগলে আয়ুক্ষয়-মাটিতে লাগালে তার প্রতিকার হয়, হাত চুলকালে টাকা আসে, ভিখারিকে উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা না দেয়া, ডুবে ¯œান না করা, ¯œান করে কিছু মুখে না দিয়ে ভিক্ষা দিতে নেই, রাত্রিবেলা আয়নাতে মুখ দেখতে নেই, চৌকাঠের ওপর বসতে নেই- তাতে পূর্ব পুরুষদের ঘাড়ে বসা হয়, পুত্র সন্তানের জন্ম হলে ঘরের ওপর দিয়ে পালি (বেতের তৈরি চাল মাপার পাত্র) ছুঁড়ে দিতে হয়Ñ তাতে সন্তান বলবান হয়।
পশু-পাখি বিষয়ক লোকাচার: নতুন গরু-ছাগল কিনে বাড়িতে এনে সে-পশুর পায়ে পানি দিয়ে গোয়ালে উঠানো, সকালবেলা কাক ডাকলে অমঙ্গল-অশুভ সংবাদ শোনার ভীতি, রাতে কোক পাখি ডাকলে অমঙ্গল হয়, বাড়ির গাছে শকুন বসা অলক্ষণের প্রতীক, দিনে শেয়াল ডাকা অলক্ষণ, রাতে কাক ডাকা দুর্ভিক্ষের আসন্ন সংকেত, ইস্টিকুটুম পাখি ডাকলে নিঃসন্তান দম্পত্তির সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, পৌষ মাসের রাতে বাড়ি থেকে কুকুর-বেড়াল তাড়াতে নেই।
অমঙ্গল বিষয় লোকাচার: পেছন থেকে ডাকলে কাজে বিঘœ ঘটে বা অমঙ্গল হয়, গামছা ও ছাতা হারানো অমঙ্গল, সন্ধ্যায় প্রদীপ না জ্বালালে অমঙ্গল হয়, ঝাঁটা কারো শরীরে স্পর্শ করা অমঙ্গল।
খাবার বিষয়ক লোকাচার: পিঠা খেয়ে সন্ধ্যারাতে বাইরে গেলে মাথায় সামান্য হলুদ না দিলে জিন-পরীর ভর করার সম্ভাবনা, খেতে বসে বিষম খেলে দূরের কেউ খেতে বসা মানুষটিকে স্মরণ করছে বলে ভাবা, হাত থেকে খাবার মাটিতে পড়ে গেলে মৃত্যুভয়ে ভীত হওয়া, একবারে বাড়া ভাতা না খাওয়া।
গাছ-পালা, ফুল বিষয়ক লোকাচার: কলা গাছের পেট দিয়ে মোছা বেরোনো অমঙ্গল, বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে রাতে খালি মাথায় না যাওয়া, রাস্তায় পড়ন্ত বাঁশ অতিক্রম করে না যাওয়া, আম-কাঁঠাল গাছে ফল না ধরলে গাস্বিতে (আশ্বিন সংক্রান্তি) তাতে দা দিয়ে কোপালে ফল ধরার সম্ভাবনা থাকে, গাস্বির দিনে আচমকা ছুলিওয়ালার গায়ে হলুদ ফুলের পানি ছেটালে তার ছুলি সেরে যায় এবং যে পানি ছিটাবে তার আর কখনও ছুলি হবে না বলে বিশ্বাস, নতুন কাপড় পরার আগে তা থেকে সুতো ছিঁড়ে তুলসি গাছকে দিলে কাপড় বহুদিন টিকে থাকে, রবিবারে বাঁশ কাটতে নেই।
প্রাকৃতিক বা প্রকৃতি বিষয়ক লোকাচার: ঝড়ের সময় ঝড়কে বসার জন্য পিঁড়া উঠোনে ছুঁড়ে দেয়া এবং ঝড় মাঠে চলে যাওয়ার জন্য উঠোনে কাঁচি ছুঁড়ে দেয়া, খালি দোলনা দোলাতে নেই।
তবে চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের লোকসংস্কার এবং লোকাচারগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেসব উপকরণ ও রীতি অবলম্বন করে লোকসংস্কার ও লোকাচারগুলো পালিত হয়ে থাকে তা ধর্মগত-জাতিগত ভেদ-রেখাগুলোকে অতিক্রম করে যায়।
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ
সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজ, চুয়াডাঙ্গা