প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগ : মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে আগুন
মাথাভাঙ্গা মনিটর: সরকারবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকার সমর্থকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছে। এতে এ পর্যন্ত সরকার দলীয় এমপিসহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক। এমনকি মাহিন্দা রাজাপাকসেসহ দেশটির মন্ত্রী, এমপি, সাবেক মন্ত্রী ও স্থানীয় নেতাদের বাসভবনে আগুন দিয়ে দেয়া হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ক্ষমতাসীন এক এমপি ও এক বিক্ষোভকারীও রয়েছেন। এছাড়া আহতদের দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কলম্বো ন্যাশনাল হাসপাতালের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, কলম্বোর সংঘর্ষের ঘটনায় আহত অন্তত ১৩৮ জনকে হাসপাতালটিতে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেছেন শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। সোমবার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন দ্বীপরাষ্ট্রটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী চান্না জয়াসুমন-ও। গত শুক্রবার মাহিন্দা রাজাপাকসের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। বৈঠকে দেশের বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত করতে নিজের বড় ভাইকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেন তিনি। এই অনুরোধ আমলে নিয়ে পদত্যাগ করলেন মাহিন্দা। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের ফলে সর্বদলীয় সরকার গঠনের যে প্রস্তাব প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া দিয়েছিলেন, তা আরও গতি পেল।
খবরে বলা হয়, সংঘর্ষ চলাকালে কলম্বোর নিতাম্বুওয়া এলাকায় বিক্ষোভকারীরা এমপির গাড়ি ঘিরে ধরেন। এসময় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালান এমপি। এতে দুই বিক্ষোভকারী গুরুতর আহত হন। পরে আহত দুইজনের মধ্যে একজন মারা যান।
শ্রীলঙ্কার পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন ওই এমপি। পরে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ওই ভবনটি ঘিরে ফেললে এমপি নিজের পিস্তল দিয়ে নিজেকে গুলি করেন।
এদিকে সদ্য পদত্যাগপত্র জমা দেয়া শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের কুরুনেগালাস্থ বাসভবনসহ রাজাপাকসে পরিবারের ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, এমপি, সাবেক মন্ত্রী ও স্থানীয় নেতাদের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করেছেন সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা।
অর্থনৈতিক সংকটকে কেন্দ্র করে দেশে চলমান আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে সরকারি সূত্র বলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী তার পদত্যাগপত্র প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠিয়েছেন।
মাহিন্দা রাজাপাকসের মুখপাত্র রোহান ওয়েলিভিটা বলছেন, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হওয়া দেশটি ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে ৭৬ বছর বয়সী মাহেন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ‘নতুন ঐকমত্যের সরকার’ গঠনের জন্য পথ পরিষ্কার করতেই প্রেসিডেন্টের অনুরোধে তিনি পদত্যাগ করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার সব রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি যৌথ ক্যাবিনেট তৈরির জন্য আমন্ত্রণ জানাতে চলেছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। দেশটির রাজনৈতিক ডামাডোলের মাঝে দেশজুড়ে কারফিউ চলছে। রাজধানী কলম্বোয় দেশের বর্তমান শাসক দল ‘শ্রীলংকা পদুজানা পেরামুনা’র সমর্থক ও সরকার বিরোধীদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। ফলে দেশটির পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বর্তমানে সবচেয়ে বড় আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলংকা। ক্ষমতাসীন রাজাপাকসের পরিবারের দুর্নীতি এবং অযোগ্যতার ফলেই এই অবস্থা বলে মনে করে শ্রীলংকার মানুষজন। দীর্ঘদিন ধরে তাদের দাবি ছিল, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা ও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগ।
কিছুদিন আগেই মন্ত্রিসভা থেকে পরিবারের সদস্যদের সরিয়ে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট। বিশেষজ্ঞরা অনেকেই মনে করছেন, দায় এড়াতেই পরিবারের সদস্যদের সরিয়ে দিয়েছেন গোতাবায়া। তবে শ্রীলংকার এই দুর্দশা যে তারই ভুলে, তা স্বীকার করেছেন গোতাবায়া। সেই ভুল শুধরে নিতে চান বলেও দাবি করেছিলেন তিনি। আগামী দিনে নতুন প্রধানমন্ত্রী দেশের হাল ধরতে পারবেন কিনা, সেদিকে তাকিয়ে শ্রীলংকাবাসী।
বিশ্লেষকদের মতে, রাজাপাকসে চীন-ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। নিজের শাসনে বেইজিংকে অনৈতিকভাবে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অনেকেই মনে করছেন, শক্ত হাতে এলটিটিই বা তামিল বিদ্রোহীদের শেষ করলেও দেশ চালাতে গিয়ে নীতিগত বিভ্রান্তির জেরে বিপাকে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ও তার ভাই। মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কায় শ্রীলংকার বাজারে রীতিমতো দাবানল। এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, সেদেশে চাল ও গম বিক্রি হচ্ছে মোটামুটি ২২০ টাকা ও ১৯০ টাকা কেজি দরে। এদিকে চিনি বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকা কেজিতে। নারকেল তেলের দর ৮৫০ টাকা প্রতি কেজি। একটি ডিমের দাম ৩০ টাকা। এমনকি মিলছে না প্রতিদিনের প্রয়োজনের রান্নার গ্যাস। এ অবস্থায় অনেকেই শ্রীলংকা ছেড়ে ভারতে চলে আসছেন। দেশজুড়ে চলছে বিক্ষোভ।
এদিকে, শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোয় শাসক দলের এক এমপির গণরোষে মৃত্যুর পর এবার জ্বালিয়ে দেওয়া হলো আরেক এমপি ও এক সাবেক মন্ত্রীর বাড়ি। শ্রীলংকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম মারফত প্রকাশ্যে আসা ভিডিওতে মাউন্ট লাফিনিয়ায় দেশের সাবেক মন্ত্রী জনসন ফার্নান্ডোর বাড়ি জ্বলতে দেখা গেছে। শ্রীলংকার পার্লামেন্টে শাসক দলেরই সদস্য সনৎ নিশান্তের বাড়িতেও বিক্ষোভকারীরা আক্রমণ করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
বিগত কয়েক মাস ধরে অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলংকায় প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। তার পদত্যাগের পরই অমরকীর্তি আতুকোহালা নামে শাসক দলের এক এমপির মৃত্যু হয় গণরোষে। শ্রীলংকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রের খবর, বিক্ষোভে গাড়ি আটকে যাওয়ায় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে ছিলেন তিনি। এরপরই তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। শোনা যাচ্ছে, মাথায় গুলি চালিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। আবার অনেকে বলছেন, বিক্ষোভকারীরা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
এ খবর নিয়ে শোরগোলের আবহে এমপি সনৎ ও সাবেক মন্ত্রী জনসনের বাড়িতে বিক্ষোভকারীদের আক্রমণের খবর প্রকাশ্যে এলো। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের দাবি, মাহিন্দা পদত্যাগ করার পরই দেশের বিভিন্ন জায়গায় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায় শাসকদলের কর্মী-সমর্থকরা। এরপরই পাল্টা মারমুখী হয়ে শাসকদলের নেতাদের ওপর হামলা চালানো শুরু করেন বিক্ষোভকারীরা। এক কথায়, অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ-পদত্যাগে শ্রীলংকা এখন জ্বলছে।