স্টাফ রিপোর্টার: নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া/আম্মাগো লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া/কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে/সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারের ছোরাতে।’ আজ ১০ মহররম। পবিত্র আশুরা। ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী ঘটনার দিন। বিশ্ব ইতিহাসেও দিনটি স্বীকৃত নির্মমতার জন্য। ইতিহাস ছাপিয়ে কারবালার মর্মান্তিক বেদনাদায়ক ঘটনা এ দিবসকে আত্মোৎসর্গ আর ন্যায়-নীতির সত্য-সুন্দর প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের চেতনায় সমুজ্জ্বল করে রেখেছে। সে সঙ্গে অন্যায়-অনাচার-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে দিবসটি। মুসলিম জাতির কাছে নানাবিধ কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ দিবস। তবে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ওফাতের বহু বছর পর ফোরাত নদীর তীরে তারই প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র এবং হজরত আলী (রা.) ও মা ফাতেমা (রা.)-এর দ্বিতীয় পুত্র হজরত ইমাম হোসেন (রা.)-এর শাহাদতবরণের ঘটনা এ দিবসকে দিয়েছে নতুন মাত্রা, নতুন মর্যাদা। সৃষ্টি করেছে অনন্য ইতিহাস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও আজ যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে পবিত্র আশুরা পালিত হবে। প্রতিবছর আশুরা উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলেও এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে সীমিত আকারে দিনটি পালন করা হবে। অন্যদিকে প্রতিবছর আশুরার দিনে তাজিয়া বের করা হয় শোকের আবহে। মূলত ইমাম হোসেন (রা.)-এর সমাধির প্রতিকৃতি নিয়ে এই মিছিল হয়। আরবি ‘তাজিয়া’ শব্দটি শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করতে ব্যবহার করা হয়। তবে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার সব ধরনের তাজিয়া, শোক ও পাইক মিছিল নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তবে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইমামবাড়াগুলোতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হবে। কিন্তু এসব অনুষ্ঠানস্থলে দা, ছোরা, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি, লাঠি ইত্যাদি বহন এবং আতশবাজি ও পটকা ফোটানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ৬১ হিজরির এই সেই দিবস যেদিন অপশক্তি-অন্যায়-অসত্যের কাছে মাথানত না করে সত্য-সুন্দর-ন্যায়ের পথে লড়াই করে বীরের মতো পরিবারের অনেক সদস্য ও সহচরকে নিয়ে শাহাদতবরণ করেন হজরত ইমাম হোসেন (রা.)। সেই দুঃখময় স্মৃতি আজও বিশ্ব মুসলিমকে কাঁদায়। সে সঙ্গে প্রেরণা জোগায় ত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যায়-অনাচার, অসত্য-অসুন্দরের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রাম করার। কবির ভাষায় ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না’। আশুরা নামকরণ নিয়ে ওলামাগণের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে। অধিকাংশের মতে, মহররম মাসের দশম তারিখ বিধায় এ নামকরণ। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় দশমী। কারও মতে, এ তারিখে মহান রাব্বুল আলামিন দশজন পয়গম্বরকে তার অনুগ্রহের দ্বারা ধন্য করেছেন বলেই এ নামকরণ। এদিন হজরত আদম (আ.)-এর তওবা কবুল হয়, মহাপস্নাবনের পর নূহ নবীর কিশতি সর্বপ্রথম মাটির সংস্পর্শ লাভ করে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) ভূমিষ্ঠ হন, হজরত দাউদ নবীর তওবা কবুল হয়, হজরত আইয়ুব নবীর রোগ-যাতনা উপশম হয়, মুসা নবীকে আল্লাহ উদ্ধার করেন, ইউনুছ নবীকে মাছের পেট থেকে মুক্তি দান করেন, ঈশা নবীকে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়। মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ হিসেবে রাখা হতো। অতঃপর যখন রমজান মাসের রোজার হুকুম অবতীর্ণ হলো তখন তা নফলরূপে গণ্য হয়। রাসূলে করিম (সা.) আরও এরশাদ করেন, রমজান মাসের ফরজ রোজার পর মহররম মাসের রোজা সর্বোত্তম (মসলিম)। তিনি আরও এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিন নিজ পরিবার-পরিজনের জন্য মুক্ত হাতে ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে সারা বছর সচ্ছলতা দান করবেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ পবিত্র কোরআনখানি, জিকির আজকার, নফল নামাজ, মাজার-কবর জিয়ারত, দান-খয়রাত প্রভৃতির মাধ্যমে পবিত্র দিবসটি অতিবাহিত করবেন। অনেকে একাধিক রোজা রাখবেন। পবিত্র আশুরা উপলক্ষে আজ রোববার সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
এই দিনে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এবং হজরত আলী (রা.)-এর পরিবারের ১৭ জন শিশু-কিশোর যুবকসহ মোট ৭৭ জন মর্দে মুজাহিদ কারবালার প্রান্তরে ফোরাতের দু’কূল ছাপা নদীর কিনারায় এক বিন্দু পানি থেকে বঞ্চিত হয়ে শাহাদতের পেয়ালা পান করেছিলেন। রাসূল (সা.)-এর দৌহিত্র হুসাইন (রা.)-এর পবিত্র মস্তক নিষ্ঠুর নরাধম শিমার ছিন্ন করে কুফার দুরাচার ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের দরবারে প্রেরণ করেছিলো। হজরত হুসাইন (রা.)-এর শিবিরে মাত্র ৪০ জন লোক ছিলো তরবারি চালানোর মতো। পক্ষান্তরে এজিদের নির্দেশে কুফার গভর্নর চার হাজার রণনিপুণ সৈন্য পাঠিয়েছিলো। এ অসম যুদ্ধে পরাজয় ও মৃত্যু ছিলো নিশ্চিত।
হুসাইনকে হত্যা করতে এজিদের নির্দেশে কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের সৈন্যরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। ফজরের নামাজের পরই ইমাম হুসাইন (রা.) তার সাথীদের দাঁড় করালেন। মাত্র ৩২ জন ঘোড় সওয়ার ও ৪০ জন পদাতিক সৈন্য নিয়ে গঠিত তার ক্ষুদ্র বাহিনী। ডানদিকে যুহাইর বিন কাইন এবং বাম দিকে হাবীব বিন মুযাইর নিজ নিজ দলের অধিনায়ক নিযুক্ত হলেন। বাহিনীকে এভাবে সাজালেন যে পিছনে তাঁবুগুলো। আর পিছনের দিকটাকে অধিকতর নিরাপদ করার জন্য পরিখাসদৃশ গভীর গর্তগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। যাতে শত্রুরা পিছন দিক থেকে আক্রমণ করতে না পারে। আর ফোরাতের পানির দখল নিজেদের জন্য নিয়ে নিলেন। যথারীতি যুদ্ধ শুরু হলো। প্রবল বীরবিক্রমে মুসলিম সৈনিকেরা শাহাদতের পেয়ালা হাতে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রায় দুই হাজার শত্রু সৈন্য খতম করে দিলেন। কিন্তু মুসলিম বাহিনী হতেও ঝরে পড়লো অনেকগুলো তরতাজা প্রাণ। ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের বা এজিদের বাহিনী পানির দখল নিয়ে নিলো।