এমনিতেই আমাদের সমাজ ঘনবসতির। ঠাসাঠাসি বসবাস। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা যখন করোনা ভাইরাসকে বিশ^ মহামারী ঘোষণা করে তার পরপরই বিশেষজ্ঞরা আমাদের দেশে সংক্রমণ ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে। ভাইরাসের প্রথম তরঙ্গে সেই শঙ্কা কাটিয়ে উঠলেও চলমান দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে শঙ্কিত এখন সচেতন সমাজ। পরিস্থিতি ক্রমশঃ বেশামালের দিকে যাচ্ছে। এরপরও সমাজের সকলে স্বাস্থ্য সুরক্ষার্থে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন না। কেউ কেউ ভাবছেন, ও আমার কিছু হবে না। যখন তাকেও ভাইরাস কাবু করছে, ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে তখন তিনিই বুঝতে পারছেন এই ভাইরাসের ভয়াবহতা। আটকে আসছে শ^াস। ঝরে যাচ্ছে প্রাণ। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু চোখের সামনেই হচ্ছে, গণমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয়ভাবে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করে সচেতনমূলক প্রচার প্রচারণা চালিয়েও প্রত্যাশিত সাড়া মেলেনি। সোমবার থেকে শুরু হয়েছে সারা দেশে লকডাউন। কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হলেও বৃহস্পতিবার থেকে ছাড় দেয়া হবে না। জরুরি সেবা ও গণমাধ্যম ছাড়া সব কিছু বন্ধ থাকবে। পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও সেনাবাহিনীও মাঠে নামবে বলে জানানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন। কতোটা ঝুঁকির মধ্যে না থাকলে সরকার এ ধরনের পদক্ষেপ নেন তা সকলকেই উপলব্ধি করা দরকার।
ভাইরাস ধনী গরিব কিম্বা মাঠে খাটা মানুষ দেখে শরীরে বাসা বাঁধছে না। মানুষের শরীর থেকে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হচ্ছে। কি কি করলে এই ভয়ানক ছোয়াচে ভাইরাস থেকে নিজে এবং অন্যকে নিরাপদ রাখা সম্ভব তা বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা বার বার জানাচ্ছে। দেশের সরকারি বেসকারি প্রতিষ্ঠানের তরফেও প্রচার প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জরুরি প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে বের হওয়া দরকার নেই। বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। একজনের সাথে আর একজনের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। করমর্দন, মোলাকাত থেকে বিরত থাকতে হবে। গণপরিবহন পরিবহার প্রয়োজন। যে পরিবহনে কিছুক্ষণ আগে একজন সোওয়ার হয়েছেন, সেই যানে আপনি উঠলে তার রাখা হাত থেকে লাগা ভাইরাস খুব সহজেই আপনার হাতের মাধ্যমে নাকে মুখে প্রবেশ করবে। ফলে ওই ধরনের যানে না ওঠাই নিরাপদ। উঠলে অবশ্যই হাত ধুতে হবে। তাও আবার কুড়ি সেকে- ধরে সাবান দিয়ে ধুতে হবে। ঘণ ঘণ হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করার কথাও বলা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এরপরও সংক্রমণের ঝুঁকি থাকছেই। ভাইরাস যেহেতু খুবই ছোয়াচে এবং ভয়ানক সেহেতু নিজ নিজ দায়িত্বেই নিজেকে এবং অন্যকে সুস্থ রাখার গুরুত্ব উপলব্ধি করা জরুরি। যদিও সমাজের বেশিরভাইগ মানুষ বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নিয়ে সুস্থ থাকার চেষ্টা করছেন, অল্প কিছু মানুষ সেই প্রচেষ্টাকে বিনষ্ট করছেন। এরা হয় অসচেতন, না হয় অধিক অর্থলিপ্সুতায় অন্ধ। আর খেটে খাওয়া মানুষদের রুটি রুজি? সেটাও তো যথাসাধ্য সরকারিভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে। অপ্রতুলতা অস্বীকার করা যায় না, তারপরও জীবনের গুরুত্ব না বুঝলে পুরো সমাজটারই যে মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছে তা অস্বীকার করবেন কীভাবে? তাছাড়া অনেকেই উপসর্গে আক্রান্ত হচ্ছেন অথচ পরীক্ষা নিরীক্ষার দিকে যাচ্ছেন না। যখন শ^াসকষ্ট বেড়ে প্রাণ যায় যায় তখনই ছুটছেন হাসপাতালে। এতে শুধু মৃতের সংখ্যাই বাড়ছে না, সংক্রমণও হচ্ছে বেশি। উপসর্গে আক্রান্ত ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হলে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে আরও বহু মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর বাসা বেধে রোগাক্রান্ত করতে ক্ষেত্র বিশেষ সময় নেয় দেড় দুসপ্তাহ। কোন ব্যক্তি আক্রান্ত হলে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে ১৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগে বলেই টানা ১৪দিন সকলকে ধৈর্য ধরে ঘরে থাকা প্রয়োজন। এ সময়ের মধ্যে আক্রান্তদের আইসোলেশনে নেয়া যেমন সহজ হয়, তেমনই এলাকাভিত্তিক অবস্থাটাও স্পষ্ট হয়। সরকারের ঘোষিত সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হচ্ছে ১ জুলাই থেকে। ৭ দিনের লকডাউনের পর আরও ৭ দিন বাড়ানোটাই সংগত। এ সময়টুকু অনন্ত সকলের সরকারি নির্দেশনা মেনে ঘরে থাকা উচিৎ। কোন যাদুমন্ত্রে কিম্বা অলৌকিক কোন বিশ^াস এই ভাইরাস থেকে বাঁচা এবং বাঁচানো সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিকভাবে এটা প্রমাণিত। তবে এটা ঠিক যে, ভাইরাস সংক্রমিত হওয়া মানেই মৃত্যু তা নয়। সংক্রমিত শনাক্ত অণুপাতে মৃতের হার এখনও ৩ শতাংশের অধিক নয়। কিন্তু মৃত্যু যে হচ্ছে এবং বাড়ছে তা অস্বীকার করার জো নেই। লকডাউন যেখানে যতো ঢিলে ঢালা সেখানে ততো ঝুঁকি। ফলে সামাজিকভাবেও লকডাউন সফল করা প্রয়োজন। যে যা করছে আমি থাকি নিরাপদে এমন ভেবে নিজেকে গুটিয়ে রেখেও স্থায়ী সুফল মিলবে না যখন, তখন অন্যেদেরও ঘরে তোলা সমাজের সচেতন মহলের দায়িত্বেরই অংশ।
ব্যবসা বহু করা যাবে। ক’দিনের জন্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলে কিছুটা ক্ষতি হবে, এই ক্ষতির চেয়ে জীবন বিপন্ন করা লোকসান যে অনেক বেশি তা না বোঝা ব্যক্তিকে কি সচেতন বলা যায়? চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের অধিকাংশ এলাকাতেই পুলিশ প্রশাসনের সাথে কিছু দোকানি, কিছু ক্রেতার লুকোচুরি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিছু ব্যক্তি জরিমানারও শিকার হচ্ছেন। কেন? ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব তো আর দু একদিনে আসেনি। দেড় বছরের বেশি সময় হয়ে গেছে। উন্নত বিশে^র বহু দেশে শতভাগ টিকাকরণ সম্ভব হয়েছে। আমাদের মত দেশে শতভাগ টিকা করণ এখনও অলিক। ফলে নিজেদের দায়িত্বেই ভাইরাস থেকে দূরে থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হবে। এই উপলব্ধি বোধ শতভাগ মানুষের মধ্যে না জাগলে সমাজ রক্ষা করা সত্যিই কঠিন। ভাইরাস থেকে যতো দ্রুত আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে সক্ষম হবো, ততো তাড়াতাড়ি আমাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে। সরকার যে নির্দেশনা জারি করেছে, ওই নির্দেশনা নিজেদের স্বার্থেই মেনে চলতে হবে। খুলনা বিভাগের মধ্যে চুয়াডাঙ্গাতেই প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়। এরপরও প্রথম ধাক্কা অনেকটাই সামাল দেয়া সম্ভব হয়। দ্বিতীয় ধাক্কা নিয়ে আসা ভাইরাসের ভারতীয় ধরণ। এধরণ যেমন দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে, তেমনই সব বয়সীদেরই অসুস্থ করছে। মৃত্যুও হচ্ছে বেশি। সকলে শতভাগ দায়িত্বশীল না হলে সকলেরই অনিবার্য সর্বনাশ।