লজ্জাহীন বেপরোয়া দুর্নীতি: সুশাসনের অবস্থা কোথায়

সম্পাদকীয়

দেশে যে ধরনের দুর্নীতি সঙ্ঘটিত হচ্ছে, তাতে অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে গত ১৫ বছরে। গণমাধ্যমের কল্যাণে সাধারণ মানুষ অবিশ্বাস্য ও অভিনব সব দুর্নীতির খবর জানতে পারছে। এর মধ্যে বালিশ আর পর্দাকা- বহুল আলোচিত দু’টি ঘটনা। এই দু’টি ঘটনা প্রতীকী হিসেবে নিয়ে দেশে দুর্নীতির ভয়াবহতা আঁচ করা যায়। আসলে এগুলো বিশাল হিমবাহের ক্ষুদ্র চূড়ামাত্র। বাস্তবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ লোপাটসহ হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্যহীনতায় প্রায় সব খাতে ভয়াবহ মন্দাভাব বিরাজ করছে। বর্তমান বাস্তবতায় তাই এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না, আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থায়। এরপরও এখনো সংবাদমাধ্যমে বিচিত্র সব দুর্নীতির কথা প্রকাশ পাচ্ছে। এটি জাতির জন্য বড় দুর্ভাগ্যের কারণ।

একটি সহযোগী দৈনিকে গতকালও দু’টি অবিশ্বাস্য দুর্নীতির খবর ছাপা হয়েছে। সিএজির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে লেখা প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত রিপোর্টের শিরোনাম- ‘অনলাইন প্রশিক্ষণেও ভেন্যু ভাড়া, নাশতা, কাগজ-কলম খরচ।’ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ বিভাগের আওতায় লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট এবং মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশন তৈরির দক্ষতা উন্নয়নের নামে দু’টি প্রকল্পে আড়াই কোটি টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। কৌতূহলোদ্দীপক হলো- প্রশিক্ষণ হয়েছে অনলাইনে। ফলে জায়গা ভাড়া নিতে হয়নি। কর্মসূচি বাস্তবায়ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে হওয়ায় প্রশিক্ষণার্থীদের সশরীরে উপস্থিতিরও কোনো প্রশ্ন নেই। লাগেনি নাশতা বা দুপুরের খাবার। কাগজপত্র সরবরাহের প্রয়োজনও পড়েনি। তবু এসব খাতে ব্যয় দেখিয়ে ভৌতিক বিল করা হয়েছে। সিএজি প্রতিবেদনে এসব বিলকে বাস্তবতাবিবর্জিত বলা হয়েছে। তবে প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, ডিপিপি অনুসারে কোনো ব্যাচের ১০০ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ হলেই মোট বিলের ৪০ শতাংশ দেয়ার বিধান রয়েছে। সে অনুযায়ী ৪০ শতাংশ বিল দেয়া হয়েছে। সিএজির নিরীক্ষা মন্তব্যে বলা হয়, যোগসাজশ করে এসব বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি টাকায় সামগ্রী কিনে তা ফেলে রাখা অর্থের অপচয়।

একই পত্রিকায় গতকাল শেষের পৃষ্ঠায় ‘গায়েবি স্কুলে বরাদ্দ আত্মসাৎ’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়, গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির আওতায় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার পয়লা ইউনিয়নের বরুরিয়া গ্রামে একটি বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাট করতে বরাদ্দ দেয়া হয় এক লাখ টাকা। কাগজপত্রে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে টাকাও তুলে নেয়া হয়। বাস্তবে ওই গ্রামে বরুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি প্রতিবেদনটি যিনি করেছেন সেই রিপোর্টার।

মূলত যারা এসব বিল করেন তাদের মতলব কী তা সহজেই অনুমান করা যায়। আসলে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে সরকারি অনেক কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় হতবিলের অর্থ হাতিয়ে নিতে যে উদগ্রীব থাকেন তার নমুনা বালিশকা- ও যার অস্তিত্ব নেই তা দেখিয়ে বিলের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা। একই সাথে সারা দেশে দলীয় লোকজনকে সরকার সুবিধা করে দিতে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দেয়। এর উদ্দেশ্য হলো- গণতান্ত্রিকভাবে জনগণের সমর্থন আদায় না করতে পারলেও যাতে দলীয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা যায়। এই চিন্তা থেকেও রাষ্ট্রযন্ত্রকে অনুকূলে রাখতে এর নিয়ামকশক্তি সব ধরনের আমলাতন্ত্রকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে নিজেদের পক্ষে রাখা।

এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দিন দিন দুর্বল হওয়া ও সুশাসন নির্বাসিত হওয়ায় আজকে আমাদের এই দুর্গতি। দুর্নীতির লাগামছাড়া বাড়বাড়ন্ত। এই দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে আমাদের কবে মুক্তি মিলবে তা আপাতত অস্পষ্ট।

Comments (0)
Add Comment