খুব দূর অতীত নয়, নিকট অতীতেই জাতি প্রত্যক্ষ করেছে পরপর তিনটি অচিন্তনীয় বাজে নির্বাচন-২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন। প্রথমটি ছিল বিরোধী দলবিহীন একতরফা নির্বাচন, দ্বিতীয়টিতে সব দল অংশগ্রহণ করেছিল বটে; কিন্তু দিনের ভোট আগের রাতে সেরে ফেলায় সেটা ছিলো এক অভিনব কারসাজির নির্বাচন আর তৃতীয়টি ছিলো সমঝোতাভিত্তিক ডামি নির্বাচন। বলা বাহুল্য, এ তিন নির্বাচনই দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি ছিল এক বড় আঘাত, একই সঙ্গে দেশের বাইরে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষতি হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করবে, গণতন্ত্রের এ ধারণার প্রতি এ নির্বাচনগুলো ছিলো চরম অবমাননা। নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিলো নানা অপশক্তির এক অশুভ চক্রের কারসাজিতে। এ চক্রে যেমন ছিলো দলীয়কৃত জনপ্রশাসন, তেমনই ছিলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া তৎকালীন সরকারদলীয় সন্ত্রাসীরাও এ প্রক্রিয়ায় শক্তি জুগিয়েছে। নির্বাচন কমিশনও সাংবিধানিক চরিত্র হারিয়ে দলীয় চরিত্র ধারণ করে প্রক্রিয়াটিতে অংশ নিয়েছিলো। অন্তর্বর্তী সরকার গত রেজিমে যেসব অনিয়ম-অন্যায়-দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, সেগুলোর একটি হলো বিতর্কিত নির্বাচনগুলোয় সংঘটিত দুর্নীতি। এ জায়গায় হাত দিতে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন জেলার ডিসি, যারা ছিলেন তার জেলার সংসদীয় এলাকাগুলোর নির্বাচন পরিচালনার জন্য রিটার্নিং অফিসার, তারা সরকারি দলকে জিতিয়ে আনতে সীমাহীন দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন। সরকারি দলের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে যেখানে যা করা দরকার, তারা সেটাই করেছেন। দিনের ব্যালট পেপার রাতে ব্যালট বাক্সে ঢোকানোর কাজটিও তারা তদারকি করেছেন। এ ধরনের ২২ সাবেক ডিসিকে শনাক্ত করা গেছে এবং তাদের সবাইকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরে কর্মরত যুগ্মসচিব ও সমপর্যায়ের পদে থাকা প্রশাসনের ৩৩ কর্মচারীকে ওএসডি করা হয়েছিলো। তাদের মধ্য থেকেও কাউকে কাউকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসরে পাঠানো হয়েছে।
সরকারের এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। প্রজাতন্ত্রের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মচারী অন্যায়-অবিচারের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, এটা হতে পারে না। উল্লেখ্য, এসব ডিসি সরকারি দলকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনার বিনিময়ে সরকারের তরফ থেকে নানাভাবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। আবার তারা ভেবেছিলেন, সরকার যেহেতু তাদের ওপর নির্ভরশীল, তাই তারা যা খুশি তা-ই করার ক্ষমতা রাখেন। এককথায়, সরকার ও তাদের মধ্যে দেয়া-নেয়ার এক চরম ক্ষতিকর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এসব ডিসিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ফলে আমলাতন্ত্রের এক নতুন ইতিবাচক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে বলে আমাদের ধারণা। বর্তমানে কর্মরত ডিসিরা এ সিদ্ধান্তকে দৃষ্টান্তমূলক ধরে নিলে তাদের পক্ষে ভবিষ্যতে কোনো অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়া সম্ভব হবে না। প্রশ্ন হলো, বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান কি তাদের জন্য যথেষ্ট শাস্তি? তারা যে অন্যায় করেছেন, তাতে সেই অপরাধের বিচারও হতে পারে। তবে একটা দিকে খেয়াল রাখতে হবে। কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যেন ব্যক্তিগত বিরোধের কারণে ব্যবস্থা নেয়া না হয়। তাহলে আমলাতন্ত্রের সৎ কর্মচারীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। প্রশাসনে অন্যায়কারী আরও কেউ বহাল আছেন কি না, তাও খতিয়ে দেখতে হবে।