ইভিএম বা ইলেকটুনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যখন প্রবল মতভেদ, তখন নির্বাচন কমিশন প্রায় দুই লাখ ইভিএম কেনার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এর জন্য খরচ হতে পারে কমবেশি আট হাজার কোটি টাকা। এমন সময়ে তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যখন আমাদের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরও প্রায় দুই লাখ ইভিএম কেনার জন্য প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত হতে পারে আগামী সপ্তাহে। গত মঙ্গলবার বৈঠক হলেও সিদ্ধান্ত হয়নি। ইভিএমের দাম ও তার বাজারদর যাচাইয়ের জন্য গঠিত কমিটি এখনো কাজ শেষ করতে পারেনি।
উল্লেখ্য, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন যে ধারাবাহিক সংলাপ করেছিল, তাতে বেশির ভাগ দলই ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দেয়। পক্ষে মত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ মাত্র চারটি দল। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন অর্ধেক, তথা ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। ৩৯ বিশিষ্ট নাগরিক যৌথ বিবৃতিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছেন। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার রাজনৈতিক ও কারিগরিভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনৈতিক ঐকমত্য না হওয়ায় গত জাতীয় নির্বাচনে খুব অল্পসংখ্যক আসনে ইভিএমে ভোট হয়েছে। এ টি এম শামসুল হুদা কমিশনের আমলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদদের তৈরি ইভিএম দিয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় পর্যায়ের বেশ কিছু নির্বাচন হয়েছিলো। সেই ইভিএমে বায়োমেট্রিকের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তকরণের সুবিধা ছিল না। আবার বর্তমানে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে ভোটার ভেরিয়েবল অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) সুবিধা নেই। এটাই বিরোধী দলের আপত্তির অন্যতম কারণ। আগের নির্বাচন কমিশন জনমত উপেক্ষা করে ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইভিএম কিনেছিল, যার প্রতিটির দাম পড়ে ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। আর ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দাম ২১ হাজার ২৫০ টাকা। এ ক্ষেত্রে তারা জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত পরামর্শক কমিটির সুপারিশও পুরোপুরি মানেনি। এখন বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে দুই লাখ ইভিএম কেনার উদ্যোগ নিয়েছে, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইভিএম ব্যবহারের উদ্দেশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন, না কেনাকাটার প্রশ্নটিই মুখ্য? বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন বড় ধরনের চাপের মুখে, তখন বিপুল অর্থ খরচ করে ইভিএম কেনা কেন? যেহেতু কমিশনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৫০ আসনে ব্যালটে ভোট হবে, বাকি আসনেও সেটি করলে বিতর্ক এড়ানো যাবে। একই সঙ্গে অর্থও বাঁচবে। যে ইভিএমের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত নয়, সে ইভিএম জোর করে চাপিয়ে দেয়ার ফল ভালো হতে পারে না। আমরা আশা করবো, এ সংকটময় মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন ঘোড়ার আগে গাড়ি জুতে দেয়ার চেষ্টা করবে না। যদি নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, তাহলে তাদের উচিত হবে ইভিএম কেনার বিলাসী প্রকল্প মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা।