নজরুল ইসলাম: চাহিদা ও বাজারদর ভালো থাকায় চলতি মরসুমেও সর্বোচ্চ ভুট্টার আবাদ হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। জেলার অন্যান্য গ্রামের মতো কোটালী গ্রামেও ব্যাপক ভুট্টার চাষ হয়েছে। লাগানো থেকে শুরু করে সকল পরিচর্যা শেষ করেছেন চাষিরা। গাছেও ধরেছে মোচা। ব্যাপক ফলন হওয়া সত্বেও কৃষকদের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে ভুট্টাক্ষেতের অজ্ঞাত রোগে। ভুট্টাগাছের মোচা পুষ্ট হওয়ার আগেই শুকিয়ে যাচ্ছে ভুট্টাগাছ। অজ্ঞাত রোগের কারণে ভুট্টাগাছের এহেন পরিস্থিতি দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। ফলে ভুট্টাচাষিরা যেমন বাড়তি ধারদেনায় জড়িয়ে পড়েছেন, তেমনি ঋণ নিয়ে আবাদ করা কৃষকরা টাকা পরিশোধ করা নিয়েও পড়েছেন দুশ্চিন্তায়।
চাষিরা বলছেন, ভুট্টাক্ষেতে রোগ লাগার ৩-৪ দিনের মধ্যে পাতা শুকিয়ে গাছ মরে যাচ্ছে। এভাবে গাছ মরে গেলে বিঘা প্রতি অর্ধলক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতি হবে। যা পুষিয়ে উঠতে অনেক চাষিরই বেগ পেতে হবে। এদিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েও ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের কোনো খোঁজখবর নেয়নি বীজ বিক্রেতা কোম্পানির প্রতিনিধিরা।
তবে, চাষিদের এতবড় ক্ষতি হয়েছে তা গুরুত্বসহকারে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা। কি কারণে এমনটি ঘটলো তা জানতে মাটির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য মৃত্তিকা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির ওপর নির্ভর করে এদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভৌগোলিকভাবে চুয়াডাঙ্গা জেলা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানকার জমি অত্যন্ত উর্বর। পলিমিশ্রিত এঁটেল, এঁটেল-দোঁয়াশ মাটির কারণে এখানে যে কোনো ফসল ভালো হয়। বর্তমানে দাম এবং ফলন আশানুরুপ হওয়ায় চলতি মরসুমে ধান গমের চাইতে ৪৯ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে ভুট্টাচাষ হয়েছে। যা বিগত দিনের তুলনায় সর্বোচ্চ। জেলার অন্যান্য গ্রামের ন্যায় কোটালী গ্রামে ব্যাপক ভুট্টাচাষ হয়েছে। সবই চলছিলো ঠিকঠাক। লাগানো থেকে শুরু করে ঘরে তোলার দ্বারপ্রান্তে। আর একটি বা দুইটি সেচ দিলেই কাটা বাদে ভুট্টার পিচে খরচের হিসাব শেষ। গাছে মোচা ধরে পাকার অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু বিধিবাম! কোটালী গ্রামের ময়নাগাড়ি, খেজুরতলা, চুলকানি, জোড়াতলা, ভরাডুবি, সুতোরদোপ মাঠের ভুট্টাক্ষেতে অজ্ঞাত ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। ভুট্টাচাষি হাবিবুর রহমান, রুপচাঁদ, মমিন, দেলোয়ার, শহিদ, নুর মোহাম্মদ, লাল মিয়া, মালেক, লালচাঁদ, ওহিদ, রাজু, মোবারক, ইউনুচ আলীসহ অনেকেই জানালেন আমাদের মাঠগুলোতে শতশত বিঘা জমির ভুট্টা শুকিয়ে যাচ্ছে। কি কারণে এমনটি হচ্ছে কেউ বলতে পারছে না। জমি বন্দক নেয়া থেকে শুরু করে প্রতিবিঘা জমিতে খরচ পড়েছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। ধান বা গমের চাষ করিনি ভুট্টার পলন ও বাজার ভালো হওয়ায়। তাই ধারকর্য, গরু, ছাগল এমন কি এনজিও থেকে লোন নিয়ে ভুট্টার চাষ করেছি। আর কয়েক দিন পর কাক্সিক্ষত ফসল ঘরে উঠবে। শোধ হবে এনজিও আর সার ডিজেলের দোকানের সবঋণ। ঋণ নিয়ে ভুট্টার আবাদ করে এখন আমাদের মাথায় হাত। কি করে ঋণ শোধ হবে তা বুঝতে পারছি না। কি কারণে এমনটি ঘটছে তার উত্তর সবরাই অজানা।
তবে কৃষকেরা অভিযোগ করে বলেন, আমাদের গ্রামের ভুট্টাচাষিরা ৭৭৫৫, ৩০৫৫, ৭১৫৫, ৯২৫৫ ও ৩৩৫৫ জাতের ভুট্টাবীজ লাগিয়েছিলো। বীজ কেনার সময় কোম্পানীর লোকজন বলেছিলো এ বীজে ভুট্টার কোনো ক্ষতি হলে সব দায়ভার আমাদের। আমাদের এত বড় ক্ষতি হলো বীজ কোম্পানির যারা এমন কথা দিয়েছিলো তাদের আর খোঁজ নেই। আবার বীজ বিক্রির সময় হলে দেখা মিলবে সেসব বাবুদের। কৃষিবিভাগ সূত্রে জানাগেছে, অতিরিক্ত সার ফসলের জমিতে ব্যবহার করলে মাটিতে সারের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়। ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। যেকোনো ফসল চাষে নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশ জাতীয় সারই বেশি ব্যবহার করা হয়। ইদানিং অনেকে জমির মাটি পরীক্ষা ছাড়া চুনও ব্যবহার করছেন। এছাড়া বাড়িতে তৈরি ছত্রাকনাশক হিসেবে কপারজাতীয় ছত্রাকনাশক বোর্দো মিশ্রণও ব্যবহার করছেন। জিঙ্ক সার হিসেবে সস্তায় পাওয়া যায় বলে দস্তা সারেরও ব্যবহার বেড়েছে। পরিমাণের চেয়ে বেশি হলে বা ব্যবহারের প্রয়োজন না হলে যেকোনো রাসায়নিক সার মাটির ক্ষতি করতে পারে। তাই মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানের অবস্থা বুঝে সার ব্যবহার করা উচিত।
অপরদিকে, এক ফসলে সার ব্যবহারের পরের ফসলে সার কম লাগে বা না দিলেও চলে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার। জমিতে একবার চুন ব্যবহারের পর পরের এক বছর চুন ব্যবহার করতে হয় না। গাছের সমস্যার কারণে কপারজাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহারের আগে মাটিতে তার অবস্থা জেনে ব্যবহার করা ভালো। প্রয়োজন হলে এমনভাবে সার ব্যবহার করতে হবে, যাতে ব্যবহারের পর মাটিতে না মেশে। অর্থাৎ সার ব্যবহারের সময় লক্ষ্য রাখা দরকার, কোনোভাবেই যেন তা মাটিতে অতিরিক্ত জমা না হয়। কারণ মাটিতে সারের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে জমিতে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন, গাছ তার জন্য বিশেষভাবে দরকারি সারের উপাদানগুলোর স্বাভাবিক গ্রহণক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কোটালী গ্রামে দায়িত্বরত কৃষি অফিসার আনোয়ার হোসেন বলেন, গতবছরই এসব জমিতে ভুট্টার চাষ না করার জন্য চাষিদের সতর্ক করা হয়েছিলো। আমার ধারণা মাঠির সমস্যার কারণে এমনটি ঘটেছে। তার পরও ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের তালিকা করে কর্তপক্ষকের নিকট প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসার তালহা জুবাইর মাসরুর বলেন, একই জমিতে একই ফসল ধারাবাহিকভাবে চাষ করলে এমনটি ঘটতে পারে। মাটির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য মৃত্তিকা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। চাষিদের এতবড় ক্ষতি হয়েছে তা গুরুত্বসহকারে দেখা হবে। কি কারণে এমনটি ঘটলো তা জানা খুবই জরুরী। বিষয়টি হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই।