আফজালুল হক: স্বামী জাহিদ হাসানকে ডিভোর্স দেয়ায় ক্ষোপে রাতের আধারে নানা শ্বশুর শামসুল শেখকে বিষ দিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। ওইদিনই হত্যার মামলায় নাতিজামাই জাহিদ হাসানকে গ্রেফতার করে সদর থানা পুলিশ। পরে এই মামলা তদন্তকারীর বিচক্ষণতায় হত্যার মূল রহস্য উঠে আসে। নাতিজামায় জাহিদ হাসান নয়, পরকীয়ার কারণেই নাতনি ও তার প্রেমিক মিলে হত্যা করে শামসুল হককে। ঘটনার পাঁচদিনের মাথায় হত্যার ঘটনা উম্মোচন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, মূলত পরকীয়ার সম্পর্ক বাঁচাতে স্বামী জাহিদ হাসানকে ডিভোর্স দেন কামনা খাতুন (১৯)। এরপর প্রেমিকের সাথে যোগাযোগের গলার কাটা হয়ে দাঁড়ায় কামনার নানা শামসুল শেখ। প্রেমিক ওহিদ হোসেন ওরফে রাশেদ আলী হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকেন শামসুল শেখকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গভীর রাতে প্রেমিক রাশেদ আলী তার প্রেমিকা কামনা খাতুনের বাড়িয়ে আসে। ঘুমন্ত নানা শামসুল শেখের দুই পা চেপে ধরে প্রেমিক রাশেদ, আর নাতি কামনা খাতুন মুখ চেপে ধরে ইনজেকশনে বিষ পুষ করে করে নানার ঘাড়ে। একদিন পর চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শামসুল শেখের মৃত্যু হয়।
পূর্বে যা ঘটেছিলো: চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বেলগাছি গ্রামের মৃত করিম শেখের ছেলে শামসুল শেখ (৬০) বুধবার (১ ডিসেম্বর) সকাল সোয়া ৮টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ওই সময় নিহত শামসুল শেখের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে জানিয়েছি, নাতনি কামনা খাতুনকে আমরা লালন-পালন করে বড় করেছি। সে আমাদের কাছেই থাকতো। বছর দুয়েক আগে জেলার দামুড়হুদা উপজেলার জুড়ানপুর ইউনিয়নের দলিয়ারপুর গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে জাহিদ হাসানের সঙ্গে পারিবারিকভাবে আমার নাতনি কামনা খাতুনকে বিয়ে দেই। বিয়ের পর থেকেই আমার নাতনিকে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন করতো জাহিদ হাসান। তার সুখের কথা চিন্তা করে যৌতুক বাবদ নগদ ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়। তারপরও থামেনি নির্যাতন। পরে নির্যাতন সহ্য করতে না পারায় ৬ মাস আগে আমার নাতনি বাধ্য হয়ে জাহিদ হাসানকে ডিভোর্স দেয়। মারধর ও নির্যাতন না করার প্রতিশ্রুতি দিলে আবারও তিন মাস পর তাদের বিয়ে হয়। এর কয়েকদিন পর আবারও নির্যাতন করতে থাকে জাহিদ। গত শনিবার (২৭ নভেম্বর) দ্বিতীয়বার কামনা খাতুন তাকে ডিভোর্স দেয়।
কামনা খাতুনও ওই দিন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে জানিয়েছিল, ডিভোর্সের পর থেকেই আমি নানা-নানির কাছে আছি। এরপর থেকে জাহিদ আমাকে ও আমার নানাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে আসছে। সোমবার (২৯ নভেম্বর) রাত ১২টার দিকে আমার নানা ঘাড়ের ব্যথায় কাতরাতে থাকে। পরে আমি ও আমার নানি গিয়ে দেখি নানার বিছানার পাশে একটি খালি ইনজেকশনের সিরিঞ্জ পড়ে আছে। এ সময় জাহিদ হাসান ও অজ্ঞাত দুজনকে পালিয়ে যেতে দেখি। আমাদের বাড়িতে কোনো পাঁচিল না থাকায় নানার ঘরে যে কেউ সহজে ঢুকতে পারে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমার নানার ওপর প্রতিশোধ নিল জাহিদ হাসান। ঘটনার কিছুক্ষণ পর নানা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা দ্রুত তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করি। বুধবার সকালে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
মামলার বিবরণ: ঘটনার দিন বুধবার সকালে কামনা খাতুনের মামা রফিকুল বাদি হয়ে কামনার ডিভোর্সকৃত স্বামী জাহিদ ও অজ্ঞাত ২/৩ জনকে আসামি করে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। ওইদিন বিকেলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান জাহিদ হাসানকে গ্রেফতার করে।
যেভাবে পুলিশের তদন্তে হত্যার মূল ঘটনা বেরিয়ে আসে : মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, মামলার দিন আসামি জাহিদ হাসানকে গ্রেফতার করি। তারপর জাহিদ হাসানকে জিজ্ঞাসাবাসে কিছুটা সন্দেহ হয়। এরপর আমি বিভিন্নভাবে খোঁজ খবর দিয়ে দেখি হত্যাকান্ডের রাতে জাহিদ উপস্থিত ছিলো না। ঘটনার মোড় অন্য দিকে যাচ্ছে। সেই ভেবে নাতী কামনা খাতুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডাকি। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের মাথায় প্রেমিক রাশেদ আলীকে নিয়ে হত্যার ঘটনা স্বীকার করে। পরে অভিযান চালিয়ে প্রেমিক রাশেদ আলীকে গ্রেফতার করি। রাশেদও হত্যার ঘটনা স্বীকার করে পুলিশের কাছে।
যেভাবে হত্যা করে নাতী ও তার প্রেমিক : মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, হত্যাকা-ের এক যাবত পূর্বে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শংকরচন্দ্র ইউনিয়নের গাইটঘাট গ্রামের রেলপাড়ার আবু সাঈদের ছেলে রাজমিস্ত্রী রাশেদ আলী সাথে কামনা খাতুনের পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাশেদ আলী অবিবাহিত। তার প্রেমিকা কামনা খাতুন বিবাহিত হওয়ায় বাধে আপত্তি। সে তাকে বিয়ের আশ্বাসে স্বামী জাহিদ হাসানকে ডিভোর্স দেয়া জন্য চাপ দিতে থাকে। সেই অনুযায়ী গত (২৭ নভেম্বর) স্বামী জাহিদ হাসানকে ডিভোর্স দেয় কামনা খাতুন। পথের কাটা কিছুটা সরলেও সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কামনার নানা। রাতে দেখা করার কারণে নাতী কামনা খাতুনকে খুবই চোখে চোখে রাখতো। কামনার কোন মোবাইল ফোন না থাকায় তার নানা শামসুল শেখের মোবাইল ফোন দিয়ে কথা বলতো প্রেমিক রাশেদের সাথে। নানা বুঝে ফেলায় কামনা খাতুনকে বকাঝকা করতো। নানী সুফিয়া খাতুন একঘরে এবং নাতী কামনাকে অন্য ঘরে রেখে শিকল দিয়ে রাখতো। বারান্দায় নানা শামসুল শেখ ঘুমাতো। এ কারণে কাটা সরিয়ে দেয়ার জন্য প্রেমিক রাশেদ আলীকে হত্যার পরিকল্পনা করে রাশেদ আলী। প্রথমে কামনা খাতুন রাজি না হলেও প্রেমিকের অনুরোধে রাজি হয় কামনা। সেই মোতাবেক গ্রামের এক পশু চিকিৎসকের নিকট থেকে একটি বড় সিরিঞ্জ সংগ্রহ করে এবং ফার্মেসি থেকে ছোট সিরিঞ্জ ক্রয় করে কামনা খাতুন। ২৯ নভেম্বর রাত ১২টার দিকে বাশের বেড়া ভেঙে রাশেদ আলী বাড়িতে প্রবেশ করে আমার ঘরের দরজা খুলে দেয়। তারপর বাড়ির বারান্দার লাইট খুলে ফেলে। পরে বারান্দায় ঘুমিয়ে থাকা নানা শামসুল শেখের দুই পা চেপে ধরে প্রেমিক রাশেদ, আর ছোট সিরিঞ্জে ঘরে থাকা ঘাষে দেয়া কীটনাশক ঢুকিয়ে মুখ চেপে ঘাড়ে পুশ করে কামনা। এতে বৃদ্ধ শামসুল যন্ত্রনায় চিতকার করলে বিছানার পাশে সিরিঞ্জ ফেলে কামনাকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শিকল দিয়ে পালিয়ে যায়। অপরদিকে প্রেমিক রাশেদ আলী ও কামনার ডিভোর্সকৃত স্বামী জাহিদ হাসানের কন্ঠসহ শারীরিক গঠন কিছুটা মিলে যাওয়ায় শামসুল শেখ চিৎকার দেয় জাহিদ হাসান বলে। পরে শামসুল শেখের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন ঘর থেকে বের হয়ে ছটফট করতে দেখে। পরে নাতী কামনাকে নিয়ে রাত ১ টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। বুধবার (০১ ডিসেম্বর) সকাল সোয়া ৮টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
কামনা খাতুনের শৈশব কাটে যেভাবে : কামনা খাতুন মায়ের গর্ভে থাকতেই বাবা ছেড়ে যান। জন্মের কিছুদিন পর মাও অন্যত্র ছেড়ে যান কামনা খাতুনকে। এরপর ঠাঁই হয় নানাবাড়িতে। তখন থেকে নানা নানা শামসুল শেখ ও নানী সুফিয়া খাতুন লালন পালন করে। কামনাকে কখনোই চোখের আড়াল হতে দিতেন না। নানী সুফিয়া খাতুন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, নাতনীকে সব সময় চোখে চোখেই রাখতাম। তার নানা রিকশা চালানোর সময় নাতনি কামনাকে সাথে নিয়েই রিকশা চালাতেন। রোদে পুড়লে নাতনি কষ্ট পাবে তাই খাবারের টাকা উঠলেই বাড়ি ফিরতেন! পরিবারের সদস্যদের অন্ন জুটাতেই হিমশিম খাওয়া সামশুল নিজ সন্তানদের পড়াশোনা না করালেও নাতনিকে ঠিকই দিয়েছেন জ্ঞানের আলো। গ্রামীণ নিয়মে ১৬ বছর বয়সেই (দুই বছর পূর্বে) পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার দলিয়ারপুর গ্রামের ভ্যান চালক জাহিদ হাসানের সাথে। কিন্তু জাহিদ হাসানের নির্যাতনে ৭ মাস পূর্বে ডিভোর্স দেন কামনা। শ্বশুরবাড়ি থেকে আবারও ফেরেন নানা বাড়ি। তিনমাস পরে দুইজনের মধ্যে সমঝোতা হলে ফের বিয়ে করেন পরস্পরকে। কামনাও ফিরেন শ্বশুর বাড়ি। আবারো গত ২৭ নভেম্বর কামনা খাতুন তার স্বামী জাহিদ হাসানকে ডিভোর্স দেন।
চুয়াডাঙ্গা কোর্ট পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আমিনুর রহমান বলেন, সোমবার চুয়াডাঙ্গা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্টেট সাইদুল ইসলামের আদালতে কামনা খাতুন হত্যার ঘটনায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবনন্দী দিয়েছেন। পরে বিজ্ঞ আদালতের বিচারক কামনা খাতুনকে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। তিনি আরও বলেন, এ মামলায় তিনদিন আগে আসামি জাহিদ হাসানকে এবং প্রেমিক রাশেদ আলীকে রোববার বিজ্ঞ আদালতের বিচারক জেলহাজতে পাঠানো নির্দেশ দেন। এছাড়া রাশেদ আলীকে ৭দিন ও জাহিদ হাসানকে তিনদিন জন্য রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমান দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, প্রথমে জাহিদ হাসানকে গ্রেফতার করি। জাহিদ হাসান তার স্ত্রী কামনাকে নির্যাতন, হত্যার হুমকির কথা স্বীকার করলেও হত্যার কথা অস্বীকার করেন। পরে নানা ঘটনা পরম্পরায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কামনাকে। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদে নাটকীয় মোড় পায় মামলা। কামনা স্বীকার করেন, ঘাড়ে ইনজেকশন পুশ করে নানাকে নিজেই খুন করেছেন তিনি। পরে সেই মোতাবেক কামনা ও তার প্রেমিককে গ্রেফতার করি। সোমবার প্রেমিক রাশেদকে নিয়ে নাতী কামনা খাতুন বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারা মোতাবেক তার নানা সামসুল শেখকে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে। রাশেদকে ৭ দিনের রিমান্ডে জন্য আবেদন করা হয়েছে। এছাড়া আরও জানার জন্য কামনার ডিভোর্সকৃত স্বামী জাহিদ হাসানকে তিনদিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, নাতিজামাই জাহিদ নয়; নাতি কামনা খাতুন ও তার প্রেমিক মিলেই হত্যা করেছে নানা শামসুল শেখকে। পরকীয়ার জেরেই তাকে হত্যা করা হয়। সোমবার বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারা মোতাবেক তার নানা সামসুল শেখকে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছেন। সব মিলিয়ে থ্রিলার একটি সিনেমাই যেনো দেখলাম গত পাঁচদিন ধরে। কিন্তু দিনশেষে সত্যটাই বের করে মূল অপরাধী ধরার পাশাপাশি একজন নিরীহের জীবনও রক্ষা করেছে সদর থানা পুলিশ।