একুশে আগস্টে গ্রেনেড হামলা মামলার যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত আসামি ধরতে র্যাবের অভিযান
স্টাফ রিপোর্টার: একুশে আগস্টে গ্রেনেড হামলা মামলার যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত আসামি ঝিনাইদহের ইকবাল হোসেন জাহাঙ্গীর ওরফে সেলিমকে (৪৭) গ্রেফতার করেছে র্যাব। সে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি) সক্রিয় সদস্য। ঘটনার দিন সে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশের মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়েছিলো। ঘটনার ১৬ বছরেরও বেশি সময় পর মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী এলাকায় র্যাবের হাতে ধরা পড়ে সে। জঙ্গি ইকবালের বাবার নাম আব্দুল মজিদ মোল্লা। তার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে। দীর্ঘ সময় ধরে নানা কৌশলে ছদ্মবেশে দেশে এবং বিদেশে আত্মগোপনে ছিলো এই জঙ্গি। সর্বশেষ গত বছরের শেষের দিকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে মালয়েশিয়া সরকার তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে ফিরে আবারও জঙ্গি কার্যক্রমে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। অবশেষে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসআই) দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। ইকবালকে গ্রেফতারের পর মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যারবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন সংস্থাটির মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘৃণিত, কলঙ্কজনক ও বিভীষিকাময় একটি দিন। ওইদিন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি বেঁচে যান। ওই হামলায় শাহাদতবরণ করেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকেই এখনো সেই দুঃসহ এবং বিভীষিকাময় স্মৃতি ও ক্ষত বয়ে চলেছেন। এরই মধ্যে ওই মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে। আদালতে দীর্ঘ সাত বছরে সর্বমোট ২২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ও শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় ঘোষণা হয়। রায়ে অভিযুক্তদের মৃত্যুদ-, যাজ্জীবন কারাদ-সহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, ওই হামলায় জড়িতদের গ্রেফতার করতে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো র্যাবও তৎপর ছিল। ২০০৫ সালে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান ও তার ভাই মুহিবুল্লাহ ওরফে মফিজ ওরফে অভিকে গ্রেফতার করেছিল র্যাব। ২০০৭ সালে ১৬টি আরজিএস গ্রেনেড উদ্ধারের পাশাপাশি এ পর্যন্ত র্যাব ১৫ আসামিকে গ্রেফতার করেছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ইকবালের ভূমিকার বিষয়ে র্যাবেব মহাপরিচালক বলেন, মুফতি হান্নানের নির্দেশে ইকবাল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে। মুফতি হান্নান তাকে গ্রেনেড সরবরাহ করে। হামলার সময় সে মঞ্চ লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়েছিলো। ঘটনার পর সে নিজের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে চলে যায়। সেখানেই আত্মগোপন করে।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, আত্মগোপনে থাকাকালে ইকবাল নিরাপত্তাকর্মী, শ্রমিক, রিকশা মেকানিকের ছদ্মবেশ ধারণ করে। তাকে ধরতে র্যাব বিভিন্ন সময় অভিযানও চালায়। ২০০৮ সালে ইকবালকে গ্রেফতারের জন্য ঝিনাইদহে তার নিজ বাড়িতে, গাজীপুর, সাভারসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলে। অব্যাহত অভিযান ও গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতার মধ্যে ২০০৮ সালে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় চলে যায়। ২০০৮ সালে ম্যানুয়াল পাসপোর্ট ছিলো। সে সময় ইকবাল নিজের নাম পরিবর্তন করে দেশ ত্যাগ করে। পলাতক থাকাবস্থাতেই তার যাবজ্জীবন দ- হয়। মালয়েশিয়ায় গিয়ে ইকবাল প্রথমে নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘সেলিম’ রাখে। পরে জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করে। অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় ২০২০ সালের শেষের দিকে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। দেশে ফিরে সে সমমনাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার কাজ করছিল।
হরকাতুল জিহাদের অন্যতম শীর্ষ জঙ্গি মুফতি হান্নানের সঙ্গে ইকবালের সরাসরি যোগাযোগ ছিলো জানিয়ে তিনি বলেন, ইকবাল ২০০৩ সালে মুফতি হান্নান ও অন্য শীর্ষনেতাদের সান্নিধ্যে আসে। তখন সে জঙ্গি প্রশিক্ষণও নেয়। ২০০৪ সালের আগস্টে মুফতি হান্নানের নির্দেশে ঢাকায় আসে ইকবাল। আশ্রয় নেয় গোপন আস্তানায়। সেখানে মুফতি হান্নান ছাড়াও অন্য জঙ্গিদের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয় তার। মুফতি হান্নানের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে দলীয় গুরুত্বপূর্ণ গোপন বৈঠকে সে অংশ নিত।
ইকবালকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাবের ডিজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ইকবাল এইচএসসি পাস। স্কুল ও কলেজে পড়ার সময় ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো। ১৯৯৪ সালে ঝিনাইদহের কেসি কলেজ ছাত্র সংসদে ছাত্রদলের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় প্রবাসী কর্মজীবী হিসাবে অবস্থান করে। দেশে ফিরে জঙ্গি ইকবাল আইএসডি ফোন ও অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে। এ সময় সর্বহারা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। ২০০১ সালে তার চিন্তা-চেতনা ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আসে। সে ঝিনাইদহের স্থানীয় এক জঙ্গি সদস্যের মাধ্যমে হুজিতে যোগদান করে।
ইকবালকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পল্টন থানা পুলিশ। ওই সময় ট্রাইব্যুনালে বিচারক না থাকায় পরে আসামিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা চলে শুরু থেকেই। ঘটনার পর শৈবাল সাহা পার্থ নামে এক তরুণ এবং মগবাজার এলাকার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেছুর রহমানকে গ্রেফতার করে তাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। পরের বছর ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে ধরে আনা হয় জজ মিয়া নামের এক যুবককে। জজ মিয়াকে ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে একটি সাজানো জবানবন্দি আদায় করে সিআইডি। ২০০৫ সালের ২৬ জুন আদালতে দেয়া ওই কথিত স্বীকারোক্তিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, তিনি আগে কখনো গ্রেনেড দেখেননি, গ্রেনেড ও বোমার মধ্যে পার্থক্য তিনি জানেন না। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন। ওই বড় ভাইয়েরা হচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল প্রমুখ। ২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করে দেন জজ মিয়ার ছোট বোন খোরশেদা বেগম। জজ মিয়াকে গ্রেফতারের পর থেকে সিআইডি তার পরিবারকে মাসে মাসে ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছিলো। জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলায় রাজসাক্ষী করতে সিআইডির প্রস্তাবের কথাও ফাঁস করে দেন তিনি। এরপর জোট সরকার আর ‘জজ মিয়া গল্প’ নিয়ে এগোতে পারেনি। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন করে এই মামলার তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। অব্যাহতি দেয়া হয় জোট সরকারের আমলে গ্রেফতার হওয়া জজ মিয়া, পার্থসহ ২০ জনকে।
গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হয়েছিল ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর। ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার টাইব্যুনাল রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদ- হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ইকবালও আছে। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- হয় আরও ১১ আসামির। দ-িত ৩৩ আসামি কারাগারে থাকলেও পলাতক ছিল ১৬ জন। ইকবাল গ্রেফতার হওয়ায় এখন পলাতক আছে ১৫ জন।