স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গার বাচেনা খাতুনের অবস্থা না বাঁচার মতোই। পেটের পাথর অপারেশন করতে গিয়ে চিকিৎসক তার পেটের ভেতরে কাঁচি রেখে সেলাই দিয়েছিলেন। সে প্রায় ২০ বছর আগের কথা। সেই থেকে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে অনেক ডাক্তারের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তিনি। এরপর যন্ত্রণার আসল রহস্য উদঘাটন হলো রাজশাহীতে গিয়ে। অন্য এক চিকিৎসক বাচেনা খাতুনের পেটের যন্ত্রণার রহস্য আবিষ্কার করলেন এক্স-রে করে। দেখা গেল আস্ত একটা কাঁচি রয়েছে তার পেটের ভেতরে। এরপরই সোমবার বিকেলে এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়। তোলপাড় শুরু হয় মেহেরপুরের স্বাস্থ্য বিভাগেও। এরপর থেকেই বাচেনা খাতুনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মঙ্গলবার দিনভর সন্ধান চালিয়েও পাওয়া যায়নি বাচেনা খাতুনকে। ধারণা করা হচ্ছে অভিযুক্ত রাজা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ কৌশলে বাচেনা খাতুনকে আড়াল করে রেখেছে। যাতে সাংবাদিকরা আর বেশি হইচই করতে না পারেন।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার চিৎলা ইউনিয়নের নওদা হাপানিয়া গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুল হামিদের স্ত্রী বাচেনা খাতুন। তিনি ২০০২ সালে পেটের যন্ত্রণায় ভুগতেন। সে সময় নিকটবর্তী হওয়ায় মেহেরপুর জেলার গাংনীর রাজা ক্লিনিকে ডাক্তার দেখান। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রাজা ক্লিনিকের পরিচালক ডা. পারভিয়াস হোসেন রাজা পিত্তথলির পাথর অপারেশনের জন্য বলেন বাচেনা খাতুনকে। ওষুধপথ্য ও অপারেশন ফি বাবদ ২০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়। স্ত্রীর অপারেশনের জন্য একমাত্র সম্বল ১০ কাঠা জমি বিক্রি করেন স্বামী আবদুল হামিদ। ওই বছরের ২৫ মার্চ রাজা ক্লিনিকে বাচেনা খাতুনের অপারেশন করেন সার্জারি বিভাগের বিশেষজ্ঞ ডা. মিজানুর রহমান। সহকারী হিসেবে ছিলেন ক্লিনিক পরিচালক ডা. পারভিয়াস হোসেন রাজা এবং অ্যানেস্থেসিয়া করেন ডা. তাপস কুমার। অপারেশনের এক সপ্তাহ পর বাচেনা খাতুনকে প্রেসক্রিপশন দিয়ে ছাড়পত্র দেয়া হয়। কিন্তু বাচেনা খাতুন কোনোদিন সুস্থতাবোধ করেননি। খুবই দরিদ্র বাচেনা খাতুন। স্বামী জনপাট খেটে কিছু আয় করেন আর নিজে কোনো রকম ছাগল মুরগি পালন করে সংসার চালান। এরই মধ্যে সুস্থ হওয়ার জন্য এ ডাক্তার থেকে ও ডাক্তার ছুটেছেন কিন্তু কিছুতেই যন্ত্রণা কমেনি তার। অসহ্য যন্ত্রণার রহস্য কেউই উদঘাটন করতে পারে না। অভিযুক্ত রাজা ক্লিনিকেও তিনি ধরণা দিয়েছেন অনেকবার। তারাও যখন গুরুত্ব দেয়নি শেষমেশ গিয়েছিলেন রাজশাহীতে। কয়েকদিন আগে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজা নাসিমের কাছে চিকিৎসা নিতে গেলে বাচেনা খাতুনকে এক্স-রে করানো হয়। রিপোর্টে দেখা যায় পেটের মধ্যে ৪-৫ ইঞ্চির একটি কাঁচি রয়েছে। ২০ বছর পর পেটের মধ্যে কাঁচির সন্ধান পাওয়ার খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাচেনা খাতুন। এমন খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে সোমবার বিকেলে বাচেনা খাতুনের বাড়িতে ভিড় জমায় এলাকার মানুষ। ছুটে আসেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও। রাজা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ বাচেনা খাতুন ও তার পরিবারকে ম্যানেজ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
বাচেনা খাতুনের গ্রামের সাবেক ইউপি মেম্বার রবিউল হক মন্টু বলেন, ‘বিষয়টি আমি সোমবার সন্ধ্যায় জানতে পারি। এরপর থেকেই বাচেনাদের বাড়িতে বিভিন্ন লোকজন আসতে থাকে। সন্ধ্যার পর গাংনীর রাজা ক্লিনিক থেকেও লোকজন আসে। তারা সাংবাদিকদের তোপের মুখ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাচেনার পরিবারকে ম্যানেজ করতে চায়। সন্ধ্যার পর ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ বাচেনাকে ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সেখানে বসে গোপনে বাচেনার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় তারা। বাচেনাকে ক্ষতিপূরণসহ অপারেশনের দায়িত্ব নেয়। সেই মোতাবেক মঙ্গলবার সকাল ১০টায় চুয়াডাঙ্গায় যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন বাচেনা খাতুন। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের সার্জিক্যাল কনসালটেন্ট ডা. ওয়ালিউর রহমান নয়নের তত্ত্বাবধানে পুনরায় অপারেশন হওয়ার কথ বলে যান গ্রামে। কিন্তু মঙ্গলবার সকাল থেকে দিনভর খোঁজ করেও হদিস পাওয়া যায়নি বাচেনা খাতুনের। এ ব্যাপারে ডা. ওয়ালিউর রহমান নয়ন জানান, ‘রাজা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ মোবাইলফোনে আমাকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জানিয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সারাদিনের মধ্যে বাচেনা খাতুন আমার কাছে আসেননি।’ এলাকার অনেকেই বলেছেন, সাংবাদিকদের তোপের মুখে না পড়তেই রাজা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ বাচেনা খাতুনকে চুয়াডাঙ্গা বা মেহেরপুরে না নিয়ে আশপাশ কোনো জেলায় নিয়ে গেছে পুনরায় অপারেশনের জন্য। এ ব্যাপারে রাজা ক্লিনিকের অন্যতম পরিচালক শামসুল আলম বলেন, ‘পেটের ভেতরে কাঁচি রেখে সেলাই দেয়াটি চিকিৎসকের একটি একটি ভুল। মানুষ মাত্রই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তবে ভুক্তভোগী বাচেনা খাতুন আমাদের পরিচালক ডা. পারভিয়াস হোসেন রাজার আত্মীয়। সেই সুবাদে বাচেনা খাতুন আমাদের কাছে পুনরায় অপারেশনের খরচখরচা চেয়েছেন। আমরা তা দিতে রাজি হয়েছি। আমরা বলেছি ওনার যেখানে ইচ্ছে অপারেশন করতে পারেন আমরা এর ব্যয়ভার বহন করব। তবে উনি কোথায় অপারেশনের জন্য গিয়েছেন তা আমরা বলতে পারব না।’
অভিযুক্ত রাজা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি না? জানতে চাইলে গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌসুমী খানম বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানতে পেরেছি। তবে ভুক্তভোগী কেউ এখন পর্যন্ত আমার কাছে মৌখিক বা লিখিতভাবে কোনো প্রকার অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে আমি অবশ্যই তদন্তপূর্বক রাজা ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’